বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির ও পাঁচবারের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য মাওলানা আব্দুস সুবহান এর স্মরণে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘পথিকৃৎ’ এর মোড়ক উন্মোচন করছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। এসময় তিনি বলেন, দেশখ্যাত আলেমে দ্বীন ও প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান মাওলানা আব্দুস সুবহান (রাহি.) এর জীবন ও কর্মের উপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে এজন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া আদায় করছি, আলহামদুলিল্লাহ। তাঁর প্রশংসা-প্রশস্তি আমাদের লক্ষ্য নয়, তিনি সমস্ত জীবনে তাঁর ব্যক্তিগত প্রশংসাকে সর্বদাই উপেক্ষা করে চলেছেন। দেশ ও দশের জন্য যার জীবন, তিনি কখনোই এটা চাইতে পারেন না। তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নেয়া, প্রেরণা গ্রহণ আমাদের জন্যে প্রয়োজন। তার মহৎ জীবন বাতিঘরের মতো। প্রতিটি কর্মই বাতিঘর যেমন পথ দেখায় এক্ষেত্রে তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, আমাদের পথ দেখায়। মাওলানা আব্দুস সুবহানের কীর্তি কথা যদি উত্তরসূরিরা স্মরণ না করে, আলোচনা না হয়, মূল্য ও মূল্যায়ন না পায় তা হলে তেলহীন নিভে যাওয়া বাতির মতো বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যারা আমাদের পথ দেখিয়েছেন, যারা পথ দেখাতে পারেন, তাঁদের সিংহভাগ আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছি। এক ধরনের সংকীর্ণ রাজনীতির কালো ছায়া আমাদের অতীতকে যেন ঢেকে দিতে যাচ্ছে। মাওলানা আব্দুস সুবহান সাধারণ পরিবার থেকে ওঠে আসা এক বিরল ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত মেধাবীছাত্র হিসাবে ছাত্র জীবন থেকে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন, পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে তিনি দেশ ও দশের কাজে কোনো রকমের দ্বিধা করতেন না। মাওলানা আব্দুস সুবহান রাজনীতিতে জনগণের সাথে থেকে রাজনৈতিক সফলতা পেয়েছেন। তিনি জনগণকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন বিধায় জনগণ তাঁকে বার বার জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করেছেন।
শনিবার সন্ধ্যায় মাওলানা আব্দুস সুবহান স্মৃতি সংসদ পাবনার উদ্যোগে ঢাকার একটি স্থানীয় মিলনায়তনে আয়োজিত স্মারকগ্রন্থ পথিকৃৎ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথা গুলো বলেন। পাবনা জেলা আমির অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডলের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম এবং উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। পাবনা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি প্রিন্সিপাল ইকবাল হুসাইনের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন পাবনা জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও স্বারক গ্রন্থের প্রকাশক মাওলানা আব্দুল গাফফার খান, পাবনা পৌর জামায়াতের আমীর ও স্বারক গ্রন্থের প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক রকিব উদ্দিন, সম্পাদক রফিকুল আলম, মাওলানা আব্দুস সুবহানের ছোট সন্তান হাফেজ মুজাহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী মিঠু প্রমুখ।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, সামাজিক সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি বেশ কিছু শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার মধ্যে পাবনা দারুল আমান ট্রাস্ট এর মাধ্যমে পাবনা ইসলামিয়া ইয়াতিমখানা, হেফজখানা, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, দারুল আমান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি, আল আমানা ম্যাটস প্রতিষ্ঠা করেন। মাওলানা আব্দুস সুবহানকে জানতে তার প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কার্যক্রম সম্পর্কে সবার দেখে আসা উচিৎ। মাওলানা আব্দুস সুবহান সামাজিক মানুষ হিসাবে তিনি সর্বদা অসহায়, দরিদ্রদের সহযোগিতা করেছেন সাধ্যমত, যা মানুষের মনে দাগ কেটেছে। সবশেষে নিজস্ব জমি বিক্রি করে মানুষের কল্যাণে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে দারুল আমান ট্রাস্টে দৃষ্টিনন্দন “মসজিদে তাকওয়া” প্রতিষ্ঠা করেন যা পাবনা জেলার সর্ববৃহৎ মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তিনি দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতে নিজের বাড়ি বাঁনিয়ে গিয়েছেন। মাওলানা সাহেবের এসকল ভালো কাজগুলো অনেকে ভালো চোখে দেখেনি বিধায় শেষজীবনে কারাগারে নির্মমভাবে জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং সেখানেই বিনা চিকিৎসায় মহান আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়, সেখানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন ‘বাংলাদেশে জনগণের অন্তরের সাথে মিশে আছে জামায়াতে ইসলামী, এতো বড় বৃহৎ সংগঠনকে দেশ থেকে মুছে দেওয়ার দুঃসাহস কারো নেই।’ এই বরেণ্য ব্যক্তির বিদায়ে আমরা ও দেশবাসী শূন্যতা অনূভব করি।
মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, বরেণ্য আলেমে দ্বীন ও ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম রাহবার মাওলানা আব্দুস সুবহান (রাহি.) ছিলেন দায়ী ও সত্যের নমুনা। তার এই গ্রন্থখানি রচনার উদ্দেশ্য শুধু একজন ব্যক্তিকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা নয় বরং তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন থেকে আমরা অনুপ্রেরণা নিয়ে যুগের পর যুগ চলার পথের সন্ধান পাবো। শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও কিভাবে এগোতে হয় তাঁর বাস্তব শিক্ষা লাভ করবো। বিশেষ করে তাঁর জীবনীগ্রন্থটি দ্বীন কায়েমের আন্দোলন ও মজলুম জনশক্তি ও দেশবাসীর জন্য মাইলফলক হিসাবে কাজে লাগবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডল বলেন, আমার দৃষ্টিতে মরহুম মাওলানা আব্দুস সুবহান রাহিমাহুল্লাহ দেশের সবচেয়ে বড় আলেমদের মধ্যে একজন, বড় একজন রাজনীতিবিদ, বড় সমাজকর্মীদের একজন, অভিজ্ঞ সংসদ সদস্যদের একজন, একজন ভাষাবিদ, সকল মহলে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, দুর্দান্ত সাহসী, অনড় মনবল, উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণী শক্তির অধিকারী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ও সমাজ উন্নয়নেরক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এমন একজন আলেমেদ্বীনের জীবন থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের শিক্ষণীয় ও পালনীয় অনেক রসদ রয়েছে।
স্বারক গ্রন্থের প্রকাশক মাওলানা আব্দুল গাফফার খানের মতে এমন একজন ব্যক্তির জীবনিগ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে আমরা সবশ্রেণির মানুষের সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি বলে জানান। এ স্বারকগ্রন্থ রচনায় যারা পরামর্শ ও সহযোগিতা করেছেন কারারুদ্ধ আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, মো. নুরুল ইসলাম বুলবুল, মো. সেলিম উদ্দিন, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম, মাওলানার ছেলে নেসার আহমেদ নান্নু। মাওলানা আব্দুস সুবহান এর জীবনীগ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে পাবনায় যাদের সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছি তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে ফরিয়াদ তিনি যেন মাওলানার জীবনের সকল ত্যাগ ও কুরবানি কবুল করে নিয়ে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। আমাদের এ নগণ্য প্রচেষ্টা যেন মানুষের কল্যাণ সাধিত করতে সহায়তা করে এবং এটা যেন মহান আল্লাহ তা’য়ালা কবুল করেন এ প্রত্যাশা করি। উল্লেখ্য যে, স্মারকগ্রন্থ পথিকৃৎ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ বিশেষ সহযোগিতা করে।