“নামাযের জন্য কারো পারমিশনের দরকার নেই মশাই। আমি রোজ ১ টার সময় নামাযের জন্য বেরিয়ে যাবোই। আপনি বরং লিখিত অর্ডার দিয়ে বন্ধ করে দিন। দেখবো আপনার মুরোদ খান।”
১৯৩৫ সাল। দুর্লভ সরকারী চাকুরী। বড় সাবের হুকুম-অফিস থেকে নামাযের জন্য যাওয়া যাবে না। বসের রক্ত চক্ষু উপক্ষো করেও জামায়াতে নামায পড়তে গিয়েছেন। এক পর্যায়ে বসের কড়াকড়িতে চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি।
চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের গেষ্ট রুম। গভীর রাত-আনুমানিক ৩টা তখন। হঠাৎ পাশের ঘরে থেকে শুনা গেলো, “রাব্বি জিদনী ইলমা” “ইয়া আইয়াতুহান্নাফসুল মুত্বমাইন্না ইরজিয়ী ইলা রাব্বিকি রাদিয়াতাম মারদিয়া, ফাদখুলি ফী ইবা-দি ওয়াদ খুলি জান্নাতি”।
পাশে শায়িত ইমাম সাহেব জেগে উঠলেন। তিনি উঁকি মেরে দেখলেন এক মর্দে মুজাহিদ আল্লাহর গভীর ধ্যানে নিমগ্ন।
দিনের বেলা আনুমানিক বিকাল ৫টা। হঠাৎ রুমে ঢুকলেন একজন। রুমে ঢুকেই দেখলেন- তিনি তাফহীমুল কুরআন পড়ছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।
১০ বছর একাধারে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন তদানীন্তন মহকুমা শহরের হাইস্কুলে। ডাক এলো আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য, মানুষকে আহবান জানানোর কাজে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। হ্যাঁ, যেমনি হুকুম তেমনি কাজ- সাথে সাথেই চাকুরী ছাড়লেন। রাজশাহী বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলেন রাজশাহীতে।
স্ত্রী ১০ বছর যাবত শয্যাশয়ী। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। কথা বলতেও পারেন না। ঢাকা থেকে মাসে একবার বাড়ী গিয়ে স্ত্রীকে এক নজর দেখে আবার ফিরে আসেন ঢাকায়। কোন টেনশন, কোন অস্থিরতা, কোন দুশ্চিন্তা কিছুই দ্বীন কায়েমের আন্দোলনের পথে তার গতিরোধ করতে পারেনি। একাকি ১০টি বছর কাটিয়েছেন। কোন কিছু যাকে টলাতে পারেনি-তিনি হলেন মরহুম জনাব আব্বাস আলী খান। রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, সংগঠক, লেখক, সর্বোপরি সকলের এক শিক্ষক জনাব আব্বাস আলী খান। অসংখ্য গুণের সমাহার এক ব্যক্তির মাঝে- এক সঙ্গে কত যে গুণ তার-তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
এক নজরে জন্ম, শিক্ষা, কর্ম ও রাজনীতি
জনাব আব্বাস আলী খান ১৩২১ সালের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে সোমবার বেলা ৯টায় জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন পাঠান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত। তাঁর দাদা সুবিদ আলী খানের মধ্যে পাঠানদের বৈশিষ্ট্য ছিল।
গরু-খাসি জবাই করে তাঁর আকিকাহ করা হয় এবং নবীজির (স) চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর নামানুসারে নাম রাখা হয় আব্বাস।
তিনি নিজ ঘরেই মৌলভী সাহেবের কাছে কুরআন শরীফের সবক নেন এবং ১৯২১ সালে ৮ বছর বয়সে নিজ গ্রাম থেকে দেড় মাইল উত্তরে এক মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন।
উল্লেখ যে, কুরআন শরীফ সবক নেয়ার আগেই তিনি আযান শিখেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, অংক, ইতিহাস, ভূগোল এবং ফার্সী অধ্যয়ন করেন।
৪র্থ শ্রেণীতেই তিনি শেখ সা’দী (র)-এর গুলেস্তা কিতাবে রপ্ত করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর তিনি বাড়ী থেকে দুইশত মাইল দূরে হুগলী মাদরাসায় পড়তে যান। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে জ্বও নিয়ে সিক বেডে পরীক্ষা দিয়েও তিনি এক বছর স্থায়ী গভর্ণমেন্ট স্কলারশীপ এবং ৪ বছর স্থায়ী মহসিন স্কলারশীপ লাব করেন।
হুগলী মাদরাসায় পড়াশুনা শেষ করে রাজশাহী সরকারী কলেজ এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোলকাতা যান। কিন্তু অভিভাবকদের ইচ্ছাক্রমে চাকুরী গ্রহণ করেন। অফিসের বড় বাবু জনাব খান সাহেব নামায পড়তে যাওয়ার কারণে সব সময় খিচিমিচি করতেন। তাই শেষাব্দি তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি। উল্লেখ্য যে, সে সময় কোলকাতায় জুমার নামাযে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবুল কালাম আযাদের খুতবাহ শুনে তার মধ্যে এক উদ্দীপনা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয়। এ সময় তিনি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও হিযবুল্লাহ বই দুটি অধ্যয়ন করেন এবং আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ভাব অবলম্বনে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখেন যা মাসিক মোহাম্মদী ও তৎকালীন ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘মুসলিম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
জনাব খান ১৯৩৬ সালের শেষদিকে আবার চাকুরীতে ঢুকেন এবং কোলকাতা ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি বেঙ্গল সেক্রেটারীয়েটে যোগদান করেন। এ সুবাদে শেওে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সেক্রেটারী হিসাবে কয়েক বছর নিয়োজিত থাকেন।
দেশে বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সার্কেল অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান। কিন্তু তিনি সে পদে যোগদান করেননি। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে জয়পুরহাটে স্থানীয় স্কুলের হেড মাষ্টার সীমান্ত পার হয়ে চলে যাওয়ায় ম্যাজিট্রেটের অনুরোধে হেড মাষ্টারের পদ গ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ইসলামী জলসা ছিল। তাঁরই ছাত্র উক্ত মাদরাসার সেক্রেটারীর অনুরোধে তিনি ঐ জলসায় যান। উক্ত জলসায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডঃ শহীদুল্লাহ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক আমীরে জামায়াত তদানীন্তন কারমাইকেল কলেজের তরুণ অধ্যাপক গোলাম আযম। ডঃ শহীদুল্লাহ অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। শুধু অধ্যাপক গোলাম আযম গিয়েছিলেন।
মরহুম আব্বাস আলী খান সাইকেলে চড়ে সভাস্থলে পৌঁছেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের মুখে কালেমা তাইয়্যেবার ব্যাখ্যা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। সভাশেষে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া ও পরিচয় হয়। জনাব খান অধ্যাপক সাহেবের কাছ থেকে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর লেখা কিছু বই পুস্তক কিনেন এবং তার কাছেই শুনতে পান যে বগুড়ার জামায়াতের দায়িত্বশীল হলেন শায়খ আমীন উদ্দিন।
১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জনাব আব্বাস আলী খান বগুড়ার দায়িত্বশীল শায়খ আমীন উদ্দিনের সাথে দেখা করে মুত্তাফিক ফরম পূরণ করেন এবং নিজ এলাকায় একটি ইউনিট কায়েম করে সেই ইউনিট চালান।
৫৬ সালের মাঝামাঝি জামায়াতের রুকন হন এবং তদানীন্তন রাজশাহী বিভাগের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জনাব আব্বাস আলী খান-এর রুকনিয়াতের শপথ পাঠ করান।
উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী (র) ১৯৫৬ সালে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এসময় থেকে খান সাহেব মাওলানা মওদূদীর (র) সান্নিধ্যে আসেন। মরহুম খান সাহেব খুব ভালো উর্দু জানতেন, তাই তিনি মূল উর্দু ভাষায় মাওলানার সবগুলো বই পড়ে ফেলেন এবং মাওলানার সান্নিধ্যে থেকে মাওলানার বক্তৃতা এবং আলোচনা ভালোভাবে হজম করেন। মাওলানা দ্বিতীয় বার পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন ১৯৫৮ সালে। এ সফরে তিনি রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রাজশাহীতে যেসব জনসভা ও সমাবেশে বক্তৃতা করেন, মরহুম খান সাহেব সেসব সভা সমাবেশে মাওলানার দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে জামায়াতের নির্দেশে তিনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকুরী ত্যাগ করেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি এবং ছাত্ররা তাঁকে কিছুতেই স্কুল থেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। এমনকি স্কুলের শত শত ছাত্র এসে তাঁকে স্কুলে ফিরিয়ে নেবা জন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে। তিনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতের মাছিগোট সম্মেলনে রওনা করে এ ঘেরাও থেকে রক্ষা পান।
১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মাছিগোটে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর রুকন সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। এ বছরই তাঁর উপর রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব অর্পিত হয়। পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনাব আব্বাস আলী খান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালের রমযান মাসে আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমকে যখন জেলে নেয়া হয় এবং ১৬ মাস বন্দী করে রাখা হয়, তখনো তিনি ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া আমীরে জামায়াত যখনই দেশের বাইরে গিয়েছেন, তখন তিনিই ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন।
জনাব আব্বাস আলী খান ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এবং জাতীয় পরিষদে ইসলাম ও গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
জনাব খান জামায়াতের সংসদীয় গ্রুপের নেতা হিসেবে আইয়ুব খানের কুখ্যাত মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্য ১৯৬২ সালের ৪ঠা জুলাই জাতীয় পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেন। অধিবেশন শুরুর আগের দিন ৩রা জুলাই আইয়ুব খান জনাব আব্বাস আলী খানকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল আইয়ুব খান তাকে মেহমানদারী করার ফাঁকে প্রস্তাবিত বিলটি জাতীয় পরিষদে পেশ না করার জন্য আকারে ইংগিতে শাসিয়ে দেন। সেই সাথে এর বিরোধীতা করার জন্য মহিলাদেরকে উসকিয়ে দেন। কিন্তু তীব্র বিরোধীতার মুখেও জনাব খান বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন।
প্রচন্ড বিরোধীতার মুখে বিলটি আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। এসময় আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেয়া ‘আপওয়া’ বাহিনীর উগ্র আধুনিক মহিলারা পিন্ডি, লাহোর ও করাচীতে জনাব খানের কুশ পুত্তালিকা দাহ করে। অবশ্য পাশাপাশি সারা দেশ থেকে জনাব আব্বাস আলী খানের নিকট অজ¯্র অভিনন্দন বার্তাও আসতে থাকে।
স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলগুলো ‘কপ’, ‘পিডিএম’এবং ‘ডাক’ নামে যেসব জোট গঠন করেছিল, তিনি ছিলেন এ জোটগুলোর অন্যতম নেতা। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যূত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জনাব আব্বাস আলী খান ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রী সভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার জনাব খানকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে তিনি দু’বছর কারাভোগ করেন।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর পুনরুজ্জীবনে জনাব আব্বাস আলী খান
১৯৭২ সালে আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সংবিধানে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত করার পর থেকে ১৯৭৯ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকাশ্যে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঢাকার হোটেল ইডেনে আয়োজিত এক রুকন সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় আতœপ্রকাশ করে।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার রাজনৈতিক দল বিধি বাতিল ঘোষণা করার ফলেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দেশে নতুনভাবে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার সুযোগ পায়। রাজনৈতিক দল বিধি বাতিল করার কয়েকমাস পূর্বে জামায়াত উক্ত দল বিধি অনুযায়ী বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্ম তৎপরতা শুরু করার জন্য মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকারের নিকট আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার নানা অজুহাতে সম্মতি দেয়নি। হোটেল ইডেনের সম্মেলনে জনাব আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমীর ও জনাব শামসুর রহমানকে সেক্রেটারী জেনারেল করে জামায়াতে ইসলামীর কাজ শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নতুনভাবে বাংলাদেশে কাজ শুরু করার পেছনে মরহুম আব্বাস আলী খান বিরাট অবদান রেখে গেছেন।
১৯৭২ সাল থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকার কারণে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কম্যুনিষ্ট ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী ভারতপন্থীরা একতরফাভাবে নানা অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল। এমনি একটি বৈরী পরিবেশে কঠিন পরিস্থিতিতে জনাব আব্বাস আলী খানকে জামায়াতের হাল ধরতে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে সাংবাদিক সম্মেলনসহ সভা-সমাবেশে যুক্তিপূর্ণভাবে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করে আল্লাহর মেহেরবাণীতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
ইসলামী বিপ্লবের ৭ দফা গণ দাবী ঘোষণা
মরহুম আব্বাস আলী খান ১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীর রমনা গ্রীণে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইসলামী বিপ্লবের সাতদফা গণদাবী ঘোষণা করেন।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তদানীন্তন বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) গড়ে উঠে, তিনি তার অন্যতম নেতা ছিলেন। এরও আগে সকল বিরোধী দল নিয়ে গঠিত ‘কপ’ (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি) এর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও তিনি একজন ছিলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিপরীতে ‘কপ’-এর প্রার্থী মিস্ ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনী প্রচারণাকালে রাজশাহী বিভাগে মিস্ জিন্নার একাধিক সভায় সভাপতিত্ব করেন। পি.ডি.এম-এর আন্দোলনের পর আরো বৃহত্তম রূপ নিয়ে গঠিত ‘ডাক’(ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি) যে আন্দোলন সৃষ্টি করে তাই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেয়। ডাক এর শরীকদল জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবে জনাব খান এ আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলে তিনি তার একজন সংগ্রামী কর্ণধার ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে ৮২ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত নয় বছরের যুগপৎ আন্দোলনে তিনি নির্ভীক ভূমিকা পালন করেন। তিনিই জামায়াতের গণআন্দোলন কর্মসূচী, কেয়ার-টেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে কেয়ারটেকার সরকার গঠনদাবী সকলের গণদাবীতে পরিণত হয় এবং সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে পার্লামেন্টে কেয়ারটেকার সরকার গঠন পদ্ধতি আইন হিসাবে পাস হয়।
আন্তর্জাতিক ভূমিকা
জনাব আব্বাস আলী খান ছিলেন একজন বহুদর্শী অভিজ্ঞ জননেতা। দেশে বিদেশে ব্যাপক সফর থেকে তিনি মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। অবিভক্ত ভারতে কোলকাতায় মরহুম শেরে বাংলার অধীনে সরকারী দায়িত্ব পালনকালে তাঁর সাথে এবং পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীত্ব কালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও শহরে তিনি ব্যাপক সফর করেন এবং তৎকালীন ভারতের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সম্মেলনে জনাব খান যোগদান করেন এবং সউদী আরবের বিভিন্ন শহল সফর করেন।
জনাব খান ১৯৭৫ সালে হজ্বব্রত পালন করেন এবং ১৯৭৮ সাওে ওমরাহ পালন করেন। এ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফ, রিয়াদ, দাহরান, জেদ্দা, তায়েফ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ব্যাপকভাবে সফরের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামী সংস্থা ও ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুযোগ লাভ করেন।
তিনি কুয়েত সফর করেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৭৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশ নঅব স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনস (IIFSO)-এর আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি মালয়েশিয়া ও সিংগাপুর গমন করেন। ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটি (FOSIS)-এর আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ১৯৮৪ সালে বৃটেন সফর করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে বিভিন্ন ইসলামী সংস্থার পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকা, কানাডা, বৃটেন ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন সম্মেলনে ভাষণ দান করেন।
সেবামূলক কাজ
মানুষের প্রতি ভালবাসা ও দুঃস্থ মানবতার প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডের সাথে তিনি আগাগোড়াই জড়িত ছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণের পেছনে তার এ মনোভাবই বেশী সক্রিয় ছিল। শিশুরা যাতে ছোট বেলা থেকেই আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে সুযোগ পায় সেজন্য জয়পুরহাটে তিনি একটি আদর্শ আবাসিক স্কুল স্থাপন করেন।
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকান্ড প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে জনাব খান সর্বদাই দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের কল্যাণে যথাসাধ্য ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে বহুক্ষেত্রেই তিনি দুর্গত মানুষের মাঝে স্বহস্তে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। উড়ির চরের জলোচ্ছ্বাসের পরপরই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ সামগ্রীসহ সেখানে পৌঁছান।
ভাষা ও সাহিত্য চর্চা
ভাষা ও সাহিত্য চর্চার প্রতি জনাব খানের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। আরবী ভাষা তিনি সুন্দরভাবে লিখতে পারতেন। বাংলা, ইংরেজী ও উর্দু ভাষায়ও তাঁর দখল ছিল এবং এসব ভাষায় বক্তৃতায় তিনি ছিলেন সাবলীল। অতি ব্যস্ততা সত্ত্বেও জনাব খান গ্রন্থ প্রণয়ন ও অনুবাদের কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। আতœ-স্মৃতিচারণ মূলক তাঁর গ্রন্থ ‘স্মৃতি সাগরের ঢেউ’ শুধু সুখপাঠ্যই নয়, তদানিন্তন সমাজের একটা দর্পনও বটে। বিলেতে সফরের উপর তাঁর লেখা ‘যুক্তরাজ্যে একুশ দিন’ এবং আমেরিকা-কানাডা সফরের উপর লেখা ‘বিদেশ পঞ্চাশ দিন’ যেমন উপভোগ্য তেমনি তথ্যবহুল ও শিক্ষনীয়। অনুবাদ ও মৌলিক রচনা মিলিয়ে জনাব আব্বাস আলী খানের প্রায় পঁয়ত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সমসাময়িক ও নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপরও সংবাদপত্রের প্রবন্ধ লিখে গিয়েছেন। প্রকাশিত এমন নিবন্ধের সংখ্যা তাঁর অনেক। তিনি অনেক ছোট গল্পের লেখক। তিনি বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেছেন। “বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস” তার এমনি একটি রচনা।
জনাব আব্বাস আলী খানের রচিত গ্রন্থাবলী
১. জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস
২. জামায়াতে ইসলামীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৩. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
৪. মাওলানা মওদূদী ঃ একটি জীবন, একটি ইতিহাস, একটি আন্দোলন
৫. আলেমে দ্বীন মাওলানা মওদূদী
৬. মাওলানা মওদূদীর বহুমুখী অবদান
৭. মৃত্যু যবনিকার ওপারে
৮. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙিক্ষত মান
৯. ঈমানের দাবী
১০. ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব
১১. একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
১২. ইসলামী বিপ্লব একটি পরিপূর্ণ নৈতিক বিপ্লব
১৩. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক
১৪. MUSLIM UMMAH
১৫.স্মৃতি সাগরের ঢেউ
১৬.বিদেশে পঞ্চাশ দিন
১৭.যুক্তরাজ্যে একুশ দিন
১৮.বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী
১৯.ইসলামী আন্দোলন ও তার দাবী
২০.দেশের বাইরে কিছুদিন
জনাব আব্বাস আলী খানের অনূদিত গ্রন্থাবলী
২১. পর্দা ও ইসলাম
২২. সীরাতে সরওয়ারে আলম (২-৫খন্ড)
২৩. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং (সহ-অনুবাদ)
২৪. বিকালের আসর
২৫. আদর্শ মানব
২৬. ইসলাম ও সামাজি সুবিচার
২৭. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
২৮. ইসলামী অর্থনীতি (সহ-অনুবাদ)
২৯. ইসরা ও মিরাজের মর্মকথা
৩০. মুসলমানদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচী
৩১. একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার
৩২. পর্দার বিধান
৩৩. ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ
৩৪. আসান ফিকাহ (১-২ খন্ড)
৩৫. তাসাউফ ও মাওলানা মওদূদী
আধ্যাত্নিক জ্ঞান চর্চা
রাজনীতি, সাহিত্য চর্চা, সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন প্রভৃতি নান কাজের সাথে জড়িত থাকলেও আধ্যাতিক চর্চার মাধ্যমে মানসিক বিকাশের প্রতি তিনি সমান গুরুত্ব দান করতেন। ফুরফুরার পীর হযরত মাওলানা আবদুল হাই সিদ্দিকী মরহুমের অধীনে আট বছর তিনি তাসাউফের চর্চা করেন।
তাছাড়া তিনি কমবেশী সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও পালন করেন। প্রায় তিন যুগ ধরে তিনি জয়পুরহাট শহরের বৃহত্তম ঈদের জামায়াতের ইমাম ছিলেন। সব মিলিয়ে জনাব আব্বাস আলী খান ছিলেন একজন পূর্ণ মানুষ হবার প্রয়াসী। একাধারে বহু গুণের অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর মধ্যে।
ইন্তেকাল
৩রা অক্টোবর ১৯৯৯ সাল, বেলা ১-২৫ মিনিটে এ মহান শিক্ষক একমাত্র কন্যা ও নাতি-নাতনীদের রেখে দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। জয়পুরহাট জেলা শহরের প্রশস্ত রাজপথ ঘেঁষে তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় তাঁকে দাফন করা হয়। কবরের কাছে রয়েছে তাঁর নিজ হাতে গড়া ইসলামী পাঠাগার।