“জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের পূর্বে “তাওহীদ” নামে আমি ১৯৫০ সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেছিলাম। এ পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগ সরকারের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা। ১৯৫২ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করার পর এ “সাপ্তাহিক পত্রিকাটি” জামায়াতের মুখপাত্র হিসেবে কাজ শুরু করে। কারণ জামায়াতের অনুকূলে কথা বলার মতো অন্য কোন পত্রিকা ছিলনা। ১৯৫৩ সালে খুলনার মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ “সাপ্তাহিক তাওহীদ” পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চেয়েছিল এবং তারা তাওহীদ পত্রিকা ও প্রেসের উপরও আক্রমণ চালিয়েছিল। মুসলীম লীগের সেই ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের মোকাবিলায় আমি অনেকটা অসহায় ছিলাম।
কোন উপায়ান্তর না দেখে আমি একান্তভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম ‘হে আল্লাহ! আমাকে ও এ পত্রিকাকে হেফাজত কর। আমার এ দোয়ার পর পরই একদল পুলিশকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম যারা আমাকে এবং আমার প্রেসকে আল্লাহর রহমতে রক্ষা করতে পেরেছে। এটা ছিল আমার জীবনের অলৌকিক ঘটনা। এ ঘটনা আল্লাহর প্রতি আমার ঈমানকে দৃঢ়তর করেছে। চরম বিপদ- আপদ ও মুছিবতে আমি কখনো হতাশ বা নিরাশ হইনি। আমি সেই ঘটনাকে এখনও স্মরণ করি এবং ইসলামী আন্দোলনের ভাইদেরকেও মনে করিয়ে দেই।”
কোন বিপদ-আপদ মুসিবতে টেনশন মুক্ত ও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাশীল ব্যক্তিটি হলেন বয়োবৃদ্ধ নেতা জনাব শামসুর রহমান। নির্ভীক বয়োবৃদ্ধ নেতা জনাব শামসুর রহমান জেনারেল এরশাদের শাসন আমলে ১৯৮৫ সালে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এক মিছিলের নেতৃত্ব দেন। জেনারেল এরশাদের পুলিশ বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে। হাসিমুখে তিনি গ্রেফতারী বরণ করেন। কারাগারের নিদারুন কষ্ট, ডায়েবেটিকস রোগগ্রস্ত এ বয়োবৃদ্ধ নেতাকে মুহুর্তের জন্যও বিচলিত করতে পারেনি।
জন্ম ও শিক্ষা
১৯১৫ সালে ৫ মে খুলনা জিলার পাইকগাছায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মুন্সী কফিলউদ্দিন আহমেদ। পাইকগাছায় তিনি তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষা লাভ শেষ করার পর ১৯৩৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর তিনি খুলনা জেলায় প্রিন্টিং প্রেস ও ষ্টেশনারীর ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথেই তিনি সাংবাদিকতার কাজও করেন এবং সাপ্তাহিক ‘তাওহীদ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি সফলতার সাথে সাপ্তাহিক তাওহীদ পত্রিকার কাজ চালিয়ে যান। এছাড়াও তিনি ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ এবং পাকিস্তানের এসোসিয়েটেড প্রেসের সাথে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। তিনি খুলনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। উল্লেখ্য যে, এর মাঝে তিনি কয়েক বছর সরকারী চাকুরীও করেন।
ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক জীবন
চল্লিশ দশকের শেষে জনাব শামসুর রহমান জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫২ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের একজন মুত্তাফিক সহযোগী সদস্য হন। ১৯৫৫ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের রুকন হিসাবে শপথ নেন। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা জেলা শাখার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। অতপর তিনি জামায়াতের খুলনা বিভাগের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগের আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। জনাব শামসুর রহমান ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে কনভেনশনের আগে জামায়াতের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য যে সাব-কমিটি করা হয় জনাব শামসুর রহমান তার আহবায়ক ছিলেন। জনাব শামসুর রহমান ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি মুজিব সরকার তাঁকে জেলে প্রেরণ করে। ১৯৭৩ সালের ১লা নভেম্বর তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পান। ১৯৮৫ সালের ২৩ এপ্রিলে তাঁকে পুনরায় আটক করা হয় এবং ৮ অক্টোবর ১৯৮৫ পর্যন্ত কারাগারে আটক থাকেন।
সমাজ সেবা
জনাব শামসুর রহমান সমাজকর্মী হিসেবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। এছাড়া তিনি অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪০ সালে বন্যা রিলিফ কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন। বয়োবৃদ্ধ এ জামায়াত নেতা সারা জীবনব্যাপী দেশের জনগণের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করেছেন এবং তিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে হজ্জব্রত পালন করেন।
জনাব শামসুর রহমান ও বেগম শামসুর রহমানের ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে। সকলেই বিবাহিত এবং ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত।
ইন্তেকাল
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমীর এবং সাবেক এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) আলহাজ্জ শামসুর রহমান ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টায় খুলনা মহানগরীর আলতাপোল লেনস্থ নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তিকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তাকে গ্রামের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাটির পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়।