বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার মাইনোরিটি (স্বল্প সংখ্যক) মানুষের সরকারে পরিণত হয়েছে। এভাবে মেজরিটি মানুষের মতের বাইরে মাইনরিটি মানুষের সরকারের শাসন কখনও বৈধতা পেতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী, এর জন্য তাদেরকে মূল্য দিতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর দেশের মেজরিটি মানুষের ইচ্ছার প্রতিফল ঘটেছিল। স্বতস্ফুর্তভাবে সাধারণ মানুষ বাইরে বেড়িয়ে এসেছিল। তাই আজ সময়ে দাবী অনুযায়ী জনগণ রাজপথে বেরিয়ে পড়েছে পরিবর্তনের জন্য এবার আর বেশি সময় প্রয়োজন হবে না ইনশাআল্লাহ।
আজ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক। বিশেষ অতিথি বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। বক্তব্যে রাখেন জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আবদুস সবুর ফকির, এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, সহকারী সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসেন, কামাল হোসাইন, ড. আবদুল মান্নান।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের বলেন, ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার ঐক্যের মূলমন্ত্র ছিল নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার ধ্বনি। তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে সরকার পরিচালনা করা হয়েছিল। যেখানে জনগণের মতের প্রতিফলন ছিল না।
তিনি বলেন, ৭ নভেম্বর কোনো নেতৃত্ব ছিল না। তবুও মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সর্বত্রই ছিল নারায়ে তাকবির ধ্বনি। এটা ছিল সবার হৃদয়ের ধ্বনি। এটা শুধুমাত্র একটা স্লোগান নয়, এটা বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মুসলমানের পথ চলা। তিনি আরো বলেন, ৭২-৭৫ সালে ইসলাম চর্চারও সুযোগ ছিল না। সকল ইসলামী দল তখন ছিল নিষিদ্ধ। শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, নেজামে ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী, মুসলিম লীগও নিষিদ্ধ ছিল। ইসলামের পক্ষে বলার কোনো শক্তি ছিল না। কিন্তু তা ছিল মানুষের হৃদয় জুড়ে। সেখান থেকে কেউ তা মুছতে পারেনি।
ডা. তাহের বলেন, মানুষের বিশ্বাসকে কখনো পরিবর্তন করা যায় না। যখনই সুযোগ আসে, তখনই তার প্রতিফলন ঘটে। এদেশকে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার অন্যায়ভাবে ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছে। এর পরিবর্তন এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের বাকে বাকে যেভাবে পরিবর্তন হয়েছিল। সেই ঐতিহ্যকে ধারন করে রাজপথে নেমে আসতে হবে।
মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক বলেন, ৭ নভেম্বর জাসদের পরিকল্পনা দেশকে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু সিপাহী জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমে আসায় তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তিনি বলেন, তৎকালীন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার মতো সেনা প্রধান পাওয়া বিরল ঘটনা। সেই দিন দেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে ছিল। সে দিন যদি সিপাহী জনতা সফল না হতো, যদি ৩রা নভেম্বরের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতো, তাহলে দেশ আজ কোথায় থাকতো, তা সহজেই বুঝা যায়। তিনি বলেন, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখুন। আমরা কী করতে পারি? কী করা উচিত? তিনি উল্লেখ করেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে সবাই একতাবদ্ধ হতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে হবে। জনগনের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র। কেন ৭ নভেম্বর হলো? কারন ওই সময় সব দল বাদ দিয়ে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। ৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে সংবাদপত্রের কন্ঠ রোধ করা হয়েছিল। সকল ইসলামী দল নিষিদ্ধ করা হয়। জনগনের অধিকার নিস্পেষিত ছিল। সেনা ও পুলিশ বাহিনীর বিপরীতে গঠন করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী। তিনি বলেন, ৭২-৭৫ সালের চিত্র এখনও বিরাজমান। সিরাজ শিকদারকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ার প্রচলন করা হয়েছিল। এখন আবারও গুম, খুন শুরু হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যার অপকৌশল গ্রহন করা হয়েছে। বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীর খোজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলন দমনে ৭২-৭৫ এর কায়দায় অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে দেশকে সে দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘নাড়ায়ে তাকবির’ ছিল ৭ নভেম্বরের চেতনা। তিনি দেশের মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে সকলের প্রতি আহবান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ৭ নভেম্বর আমাদের জাতিসত্তার পুণর্জন্ম ও পুনর্গঠনের দিন। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা একদলীয় শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা উপহার দিয়েছিল। ৭ নভেম্বর গৌরবান্বিত ও ঐতিহাসিক দিন। এদিন সিপাহী-জনতার সম্মিলিত ও সংগ্রামী ভূমিকার কারনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে, জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামের পরিচিতি বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়। এর পথ ধরে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, আমদানিকৃত সেক্যুলারিজম বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান ও পূর্ণ আস্থা হবে সকল কর্মকান্ডের উৎস’ এবং ও সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ সংযোজিত হয়। এদিনের পথ ধরে একদলীয় বাকশালের জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত হয়ে জাতি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মূলত: ৭ নভেম্বর আমাদের জাতিসত্তার পুনর্জন্ম ও পুনর্গঠনের দিন। তিনি বলেন, ৭ নভেম্বর নিছক কোন দিন নয়, এদিন সিপাহী-জনতার ঐক্য সংহতির দিন। যে ঐক্য ও সংহতি এদেশের বিরুদ্ধে বড় রকমের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়, এদেশের মানুষের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বের ক্যু’র মাধ্যমে আবারো ঘড়ির কাটা পিছনে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ৭ নভেম্বর সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছিল। ৭ নভেম্বর কালেমা তাইয়্যেবার ধ্বনি প্রতিধ্বনি ইসলামী জাতিসত্তার পুণর্জাগরনের উৎসবে পরিণত হয়েছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ গভীর সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত। আইনের শাসন ভূলন্ঠিত, গণতন্ত্র নির্বাসিত ও মানবাধিকার বিপন্ন। সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যহার করে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ সকল মৌলিক অধিকারের পথ সংকুচিত করে চলেছে। সেদিন নাড়ায়ে তাকবির আল্লাহু আকবারের ধ্বনিতে যেভাবে একনায়কতান্ত্রিক, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে দেশ ও ইসলাম প্রেমিক জনতা বাংলাদেশে একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। আগামীদিনেও একইভাবে সকল আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবেলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঢাকা মহানগরী দক্ষিনের নায়েবে আমির জনাব আব্দুস সবুর ফকির বলেন, ইসলামী তাহজিব ও তমুদ্দুন এদেশে ছিল পরাধীন। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এদেশে আবার ইসলামী তাহজিব ও তমুদ্দুনের স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালে আমরা একটি মানচিত্র পেয়েছি কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা এখনো পাইনি। এখনো আমাদেরকে গণতন্ত্রের জন্য লড়তে হচ্ছে। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় যাদের বেতন হয় তারা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বুলেট দিয়ে আমাদের রক্তাক্ত করছে। আমাদের ভোটের জন্য ভাতের জন্য খুন হতে হচ্ছে। স্বাধীনতার নামে এর থেকে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে!
এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ৭২-৭৫ এর শাসনকালে দেশে বাকশাল কায়েম হয়েছিল, সন্ত্রাস নৈরাজ্যে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল, পত্রিকা বন্ধ করে মানুষের কন্ঠ রোধ করা হয়েছিল। সেই ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে সিপাহী জনতা বিপ্লব করে। তিনি বলেন, দেশে আজ সেই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায়না। তাই রাজপথে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নামতে হবে।
ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, গভীর অন্ধকারে বাংলাদেশ নিমজ্জিত। ইতিমধ্যে ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের উস্কানীমূলক বক্তব্যের পর এসব হত্যাকান্ড সংগঠিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, জনপ্রতিনিধিরাও রেহাই পাচ্ছে না। জনগনের স্বতস্ফুর্ত আন্দোলন থামিয়ে দিতে, জনগনের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করার জন্য অপকৌশল গ্রহন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৫৭ সেকেন্ডে ৪৭টি ভোট দেওয়ার রেকর্ড যখন হয়, তখন জাতির বুঝতে আর বাকী থাকার কথা নয়, এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন কেমন হতে পারে? তিনি উল্লেখ করেন, ষড়যন্ত্র করে গণআন্দোলন কখনও বন্ধ করা যাবে না।