ওশর নামাজ রোজার মতোই ফরজ ইবাদত। আমাদের দেশে আমরা যাকাতের সাথে পরিচিত এবং যাকাতের প্রচলন কিছুটা থাকলেও যাকাতের উল্লেখযোগ্য খাত ‘ওশর’ বর্তমানে চালু নেই। মুসলমানদের জন্য অতীব পরিতাপের বিষয় ‘ওশর’-এর ন্যায় ফরজ একটা অর্থনৈতিক ইবাদত সম্পর্কে কারো তেমন অনুভূতি নেই। যাকাত ও ওশর দারিদ্র্য বিমোচনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। পরিকল্পিত উপায়ে যদি যাকাত এবং ওশর আদায় করা হয় তাহলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার যাকাত এবং লক্ষ লক্ষ টন ফসল ওশর হিসেবে আদায় করা সম্ভব। ইসলামী অর্থনীতির দুটো ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে এবং দারিদ্র্য জাদুঘরে পালাতে বাধ্য হবে।
ওশরের সংজ্ঞা
শরিয়তের পরিভাষায় ওশর হচ্ছে উৎপাদিত ফসলের যাকাত যা কোনো জমির উৎপাদিত ফসলের যাকাতকে ওশর বলা হয়। এক কথায় ফসলের যাকাতকে ওশর বলে। অর্থাৎ যে জমিতে সেচ দিয়ে ফসল ফলাতে হয় সে ক্ষেত্রে ফসলের ১/২০ অর্থাৎ বিশ ভাগের (১) একভাগ এবং সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদিত হয় সে ফসলের ১/১০ অর্থাৎ দশ ভাগের (১) এক ভাগ ওশর বা যাকাত দিতে হবে।
ওশরের নিসাব
ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ) বলেছেন- জমিতে উৎপন্ন ফসল কম অথবা বেশি হোক নদী-ঝর্নার পানিতে উৎপন্ন হোক বা বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন হোক কোনো তারতম্য ছাড়াই ১/১০ অর্থাৎ এক-দশমাংশ -ওশর (যাকাত) দিতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে পাঁচ ওয়াসাক বা (৩০) ত্রিশ মণের কম হলে ওশর ফরজ হবে না। কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের ১/২০ অর্থাৎ বিশভাগের (১) একভাগ ওশর আদায় করতে হবে। ওশর ফসল ও দেয়া যেতে পারে বা ফসলের মূল্য ও দেয়া যাবে।
ওশর সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা
আমদের সমাজে অনেক দ্বীনদার ও আলেমকে বলতে শোনা যায় যে, আমরা জমিনের খাজনা বা কর দিয়ে থাকি তাই ‘ওশর’ দিতে হবে না। আবার কেউ কেউ বলেন আমরা তো আনুমানিক ‘ওশর’ মাদ্রাসা মক্তবে দিয়ে থাকি তাতে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। অথচ যাকাত ওশরের হুকুম, যে খাতে যাকাত দিতে হবে, ঠিক সে খাতেই ওশর দিতে হবে। এমনি ধরনের বিভিন্ন সমস্যা ও বিভ্রান্তি হতে মুসলিম উম্মাহকে বাঁচাতে হলে ওশরের ব্যাপারে কুরআন-হাদিস এবং আম্বিয়ায়ে কিরামদের মতামত ও নির্দেশ জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ওশর আদায় করতে হবে।
ওশরের গুরুত্ব
ওশর দারিদ্র্য দূরকরণের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। যাকাত যেভাবে দারিদ্র্য দূর করে। তেমনি ওশর ও দারিদ্র্য দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই নি¤েœ কুরআন-হাদিসের আলোকে ওশরের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপার্জনের উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে খরচ করো এবং সে সম্পদের মধ্যে থেকেও যা আমি তোমাদের জন্য জমিন থেকে উৎপন্ন করেছি।”
(সূরা বাকারা : ২৬৭)
মহান আল্লাহ তায়ালা আরোও বলেন- “তোমরা ফসলের উৎপাদন খাও, যখন তাতে ফল ধারণ করবে এবং আল্লাহর হক আদায় করো। যখন শস্য কাটবে (আহরণ করবে) এবং সীমালঙ্ঘন করো না।” (সূরা আনআম : ১৪১) রাসূল সা.-এর মাধ্যমে আমরা ওশর আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারি।
আবদুল্লাহ বিন ওমর রা. হযরত নবী করীম সা. হতে বর্ণনা করেছেন, যে ফসল আকাশ বা প্রবহমান কূপের পানি দ্বারা অথবা নালার পানি দ্বারা সিক্ত হয় (ফসল উৎপন্ন হয়) তাতে ওশর ১/১০ অর্থাৎ এক-দশমাংশ আর যা সেচ দ্বারা সিক্ত হয় তাতে ১/২০ অর্থাৎ বিশ ভাগের একভাগ ওশর আদায় করতে হবে। (বুখারি)
হযরত মায়াজ ইবনে জাবাল রা.কে ইয়েমেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে নবী করিম সা. যে নিয়োগপত্র দিয়েছিলেন তাতে উল্লেখ ছিলো- মুসলমানদের জমি হতে উৎপন্ন ফসল ১/১০ (এক দশমাংশ) আদায় করবে যখন বৃষ্টি বা ঝর্নার পানিতে স্বাভাবিকভাবে ফসল উৎপন্ন হবে, কিন্তু যেসব জমিতে আলাদা ভাবে পানি দিতে হয় তা হতে ১/২০ ভাগ অর্থাৎ বিশভাগের একভাগ আদায় করতে হবে। (ফতদুল বুলদান- ৮১পৃ:) কুরআন ও হাদিসের উল্লিখিত নির্দেশের আলোকে ওশর আদায়ের গুরুত্ব ও ওশরের নিসাব আমাদের নিকট সুস্পষ্ট।
ওশর (যাকাত) না দেয়ার পরিণাম
যেহেতু নামাজ, রোজার ন্যায় ওশর ও ইসলামের একটি মৌলিক ফরজ, সেহেতু ওশর আদায় না করা শরয়ি দৃষ্টিতে কত মারাত্মক অপরাধ ও ঈমানবিরোধী কাজ তা সহজেই বোঝা যায়। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট ঘোষণা- “যারা সোনা-রূপা সঞ্চয় করে অথচ আল্লাহর নির্ধারিত পথে ব্যয় করে না (অর্থাৎ যাকাত / ওশর দেয় না) তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন, যে দিন সে সম্পদকে দোজখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে পরে কপাল, পাঁজর এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে (আর বলা হবে) স্বাদ গ্রহণ করো দুনিয়াতে যা জমা ছিলো।” (সূরা তওবা : ৩৪-৩৫)
হাদিসে রাসূল সা.-এর মধ্যেও ওশর/যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ রয়েছে- হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে তার ওশর/যাকাত আদায় করে না কিয়ামতের দিন ঐ ধন-সম্পদকে তার জন্য একটি ভয়ঙ্কর বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে, যার চোখ দুটোর ওপর দুটো কালো বিন্দু থাকবে, সাপটি এ ব্যক্তির গলায় তার দু’গালে কামড়াতে কামড়াতে বলতে থাকবে আমি তোমার ধন-সম্পদ আমি তোমার সঞ্চিত ধনভাণ্ডার। (বুখারি)
ওশর/যাকাত আদায় না করে কৃপণতা প্রদর্শন বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন-
“আল্লাহ যাদেরকে আপন ফজল হতে (সম্পদ) কিছু দান করেছেন না নিয়ে তারা কৃপণতা করে, তারা যেন এ কথা মনে না করে যে, ইহা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং ইহা তাদের জন্য অকল্যাণ বা ক্ষতিকর। যে সম্পদ নিয়ে তারা কৃপণতা করছে কিয়ামতের দিন উহা শিকল রূপে তাদের ঘাড়ে পরিয়ে দেয়া হবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১৮০)
ওশর/যাকাত অস্বীকারকারীর প্রতি শরিয়তের বিধান
ওশর /যাকাত যে ফরজ তা কুরআন ও হাদিস থেকে প্রমাণিত। তাই ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ফরজকে অস্বীকারকারী হলো কাফের বা মুরতাদ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ওশর আদায় না করাকে মুশরিকদের কাজ বলেছেন।
“ধ্বংস অনিবার্য, ঐ সকল মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত (ওশর) আদায় করে না।”(সূরা হামীম আস সাজদা : ৬-৭)
হযরত আবু বকর রা. তার খিলাফত আমলে ঘোষণা করেছিলেন- “আল্লাহর কসম যারা রাসূলের জীবদ্দশায় যাকাত/ওশর দিতো, তারা যদি আজ ছাগলের একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে তবে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।” “তখন হযরত ওমর রা.সহ সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রশ্ন করেন, যারা তাওহিদ, রিসালাতে বিশ্বাসী, নামাজও আদায় করে শুধু মাত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করাতে তাদের বিরুদ্ধে য্দ্ধু ঘোষিত হবে কেন? অবশেষে হযরত আবু বকর রা.-এর যুক্তি ও দৃঢ়তার কারণে সাহাবায়ে কেরাম একমত হয়ে ‘ইয়ামামার’ যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
(বুখারি-১৩৯৯, মুসলিম-২০, সুনানে নাসায়ী-৩০৯১)
সুতরাং ইসলামের অন্যান্য বিধান মানার পরও যদি শুধু যাকাত দিতে অস্বীকার করে বা যাকাত/ওশর আদায় না করে মূলত তারা ইসলামকেই অস্বীকার করলো।
যাকাত ও ওশরের পার্থক্য
ওশর জমির যাকাত এবং অন্যান্য সম্পদের যাকাত থেকে স্বতন্ত্র। তাই ইসলামে ওশরকে যাকাত থেকে ভিন্ন ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নি¤েœ ওশর ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হলো-
– ওশর দেয়ার জন্য ফসলের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। জমির ফসল বাড়িতে এনে পরিমাপ করার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফসলের ওশর দেয়া ফরজ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য সম্পদের যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। এ পার্থক্যের কারণে বছরে বিভিন্ন মৌসুমে যে কয়টি ফসল পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটির উপর ভিন্ন ভিন্নভাবে ওপর ফরজ হয়।
– ওশর ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়া শর্ত নয়। যাকাতের ব্যাপারে ঋণ পরিশোধ করার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকলে তার ওপর যাকাত ফরজ হয়। কিন্তু ওশর আগে দান করার পর ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
– ওশর ফরজ হওয়ার জন্য সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া শর্ত নয়, নাবালেগ ও পাগল ব্যক্তির ফসলের ওশর ফরজ হয়, কিন্তু তাদের সম্পদে যাকাত ফরজ হয় না।
– ওশর ফরজ হওয়ার জন্য জমির মালিক হওয়া শর্ত নয়। শুধু ফসলের মালিক হওয়া শর্ত।
– যদি কোন মুসলিম অন্য কারো জমি বর্গা বা ইজারা নিয়ে ফসল উৎপন্ন করে অথবা ওয়াকফ কৃত জমি চাষ করে ফসল পায় তবে তাতে ওশর ফরজ হয়। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত।
ওশর আদায়ের প্রক্রিয়া
ওশর আদায়ের বিভিন্ন প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো-
– ফসলের মালিক যদি উত্তোলনের শুরুতেই ফসলের পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন তাহলে প্রথম থেকেই ওশর পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু শুরুতেই যদি নিসাব পরিমাণ না হয় তাহলে প্রথম উত্তোলন থেকেই হিসাব রাখতে হবে এবং যখন নিসাব পরিমাণ পৌঁছে যাবে তখন থেকেই ওশর পরিশোধ করতে হবে।
– ফসল উত্তোলনের আগে যদি মালিক মারা যায়, তার উত্তরাধিকারীগণ ওশর পরিশোধ করবে।
– এক বছরে ব্যক্তি ভোগ করার পর যদি সঞ্চিত থাকে তাহলে যাকাত ধার্য হয়, কিন্তু ওশরের ক্ষেত্রে ফসল যখন কাটা হয় তখনই ভোগ ব্যয়ের পূর্বেই গণনা করতে হবে।
– ফসল যখনই ব্যবহার যোগ্য হবে তখনই তার উপর ওশর প্রযোজ্য হবে।
– জমির খাজনা দিলে ওশর মওকুফ হয় না।
– ওশর মোট উৎপাদিত ফসলের উপর আদায় করতে হবে। আন্দাজ বা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ওশর/যাকাত দেয়া যাবে না, দিলে তা সাদকা হিসেবে গণ্য বা আদায় হবে না।
ওশর প্রযোজ্য হবে না
ফসলের যে অংশের ওপর ওশর প্রযোজ্য হবে না তা নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
– ফল বা ফসলের যে অংশ চাষ কাজে ব্যবহৃত গবাদিপশু ভক্ষণ করা অংশ।
– পথচারীগণ কর্তৃক ভক্ষণ করা অংশ।
– জনহিতকর কাজে দানকৃত অংশ।
ওশর/যাকাত ব্যয়ের খাত
মুসলমানদের সকল সম্পদ যাকাত গৃহপালিত পশু, সোনা রূপা ও মুদ্রা, ব্যবসায়ের মাল, খনিজসম্পদ ও ওশর আদায় এবং তার ব্যয়ের খাত স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “যাকাতের সম্পদ শুধুমাত্র ফকির, মিসকিনদের আর যারা যাকাত আদায়ের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত, মুয়াল্লাফাতে কুলুবদের জন্য, ক্রীতদাস মুক্ত করার জন্য। ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার জন্য, আল্লাহর রাস্তায় ও নিঃস্ব মুসাফিরদের জন্য, ইহা আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ, আল্লাহ সর্বজ্ঞ সুকৌশলী। (সূরা তওবা : ৬০)
উল্লিখিত খাতসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করা হলো-
ফকির : যারা একেবারেই নিঃস্ব সহায় সম্পদ বলতে কিছুই নেই প্রয়োজন পূরণে এরা অন্যের নিকট হাত পাততে বাধ্য হয়।
মিসকিন : এমন দরিদ্র ব্যক্তি যার সামান্য সম্পত্তি আছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। স্বাভাবিক জীবন যাপনে টানাটানি হয় এবং কোনো কিছু চাইতেও পারে না এমন লোককে মিসকিন বা গরিব ভদ্রলোক বলা হয়। হযরত ওমর রা. কর্মক্ষম অথচ বেকার লোকদেরকেও মিসকিনদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
যাকাত বিভাগের কর্মচারী : এ বিষয়টি ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রীয় ভাবে যাদেরকে যাকাত/ওশর আদায়ের জন্য নিয়োগ করা হবে তাদের বেতন দেয়ার কথা বুঝানো হচ্ছে।
মন জয় করার কাজে : দ্বীনের দিকে আহ্বানের জন্য অন্য কোনো সম্প্রদায়কে সাহায্য সহযোগিতা করা।
দাস মুক্তির জন্য : এ পদ্ধতি বা প্রথা রাসূল সা. এরপর থেকে আর চালু নেই। তবে বর্তমানে জরিমানার অভাবে যারা জেলে বা অন্য কোথাও আটক থাকে তাদের মুক্তির জন্য ওশর/ যাকাত দেয়া যেতে পারে।
ঋণপরিশোধ করা : যে ব্যক্তি ঋণী অথচ ঋণপরিশোধ করার মতো কোন সামর্থ্য নেই। এমন ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে যাকাত/ওশরের টাকা ব্যয় করা যাবে।
আল্লাহর পথে : আল কুরআনের পরিভাষায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অর্থ অনেক ব্যাপক ও অর্থবহ। এখানে জরুরি কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-
– মুসলমানদের যাবতীয় নেক কাজকে আল্লাহর পথে বলা যায়।
– যে মুসলিম অর্থাভাবে দ্বীন শিক্ষা করতে পারবে না তাকে ওশর/যাকাত দেয়া যাবে।
– যে মুজাহিদ অর্থাভাবে যুদ্ধে যেতে অক্ষম তাকে ওশর/যাকাতের টাকা দেয়া যাবে।
– দ্বীনের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করতে টাকার অভাব হলে সেক্ষেত্রে
– ওশর/যাকাতের টাকা দেয়া যাবে।
– ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে যারা নিয়োজিত তাদের আর্থিক দুর্বলতা দূর করার জন্য ওশরের টাকা দেয়া যাবে।
– ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে যেমন- সাহিত্য, পত্রিকা, মিডিয়া ও শিক্ষামূলক ইসলামী চলচ্ছিত্র নির্মাণ, ইসলামী গান, নাটক সর্বোপরি ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে ওশর/যাকাত ব্যয় করা যাবে।
– ইকামাতে দ্বীনের সার্বিক কাজই ফি সাবিলিল্লাহর কাজ। তাই এ কাজে ওশর/যাকাতের টাকা ব্যয় করা যাবে।
– ইকামাতে দ্বীনের কাজে নিয়োজিত ইসলামী সংগঠনকে যাকাত দেয়া অধিকাংশ- ওলামায়ে কিরামের মতে সর্বোত্তম। ওশর/যাকাতের সফলতা বাধ্যবাধকতা বা ফরযিয়াত তখনি আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারবো যখন এ দেশে-ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলামী রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যাকাত/ ওশরের সুফল পাওয়া যাবে না। তাই ফি সাবিলিল্লাহ এ খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
– মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করে ফুল টাইম দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও সেবামূলক কাজে যাকাত/ ওশরের টাকা ব্যয় করা।
মুসাফির : যে ব্যক্তি নিজ বাড়িতে সম্পদশালী কিন্তু মুসাফির অবস্থায় অর্থাভাবে পথচলা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তিকে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির কাজ কর্ম সম্পর্কে অবগত রয়েছেন এবং তিনি শুধু জ্ঞানীই নন বরং সর্বজ্ঞ।
ওশর ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলা
আমাদের দেশে যাকাত যতটা পরিচিত ঠিক ওশর ততটা অপরিচিত। তাই এ ব্যবস্থাকে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য নি¤েœাক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
– ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎসাহিত ও অবহিতকরণের জন্য ওশরকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা।
– তাফসির মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল ও মসজিদের খুতবাহ ব্যাপক আলোচনা করা।
– এ বিষয়ে সময় সময় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপের আয়োজন করা।
– ফসলের মৌসুমে পাড়ায় মহল্লা বিশেষ ক্যাম্পেইন এর ব্যবস্থা করা।
– ক্যাম্পেইন উদযাপনের জন্য বিস্তারিত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা।
– এ উপলক্ষে মাইকিং, পোস্টারিং, লিফলেট, বিভিন্ন প্রকাশনা ও গ্রাম্যমেলার আয়োজন করা।
– ওশরের ওপর প্রতি বছর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
– ওশর সঠিকভাবে আদায় এবং বিতরণের জন্য মহল্লাভিত্তিক কমিটি গঠন করা।
– ফসলের মৌসুমে ওশর কি পরিমাণ আদায় ও বিতরণ হলো- তার খাতওয়ারি তালিকা প্রকাশ করা।
– ভালো কাজে প্রতিযোগিতার জন্য ওশর আদায়কারী ও প্রদানকারীকে পুরস্কৃত করা।
– ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে- জাতীয় ভাবে পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া অর্থাৎ- টিভি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনগণকে অবহিত ও উৎসাহিত করা।
– ওশরের প্রচার ও প্রসারের জন্য সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগ গ্রহণ এবং ওশর ও যাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ।
– অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাকাত/ওশর জন্য আলাদা বিভাগ করে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা।
– ওশর/যাকাত বিভাগের মাধ্যমে প্রতি বছর বা প্রতি মৌসুম ওশর/যাকাত আদায় ও বিতরণের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা।
পরিশেষে বলা যায় যে, ওশর/যাকাত মহান আল্লাহ পাকের বিধান এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া। এই বিধান অনুসারে যে সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার ওশর/যাকাত দিতে হয়। ফসলের যাকাত বা ওশর ফসল কাটা-মাড়ার সময় আদায় করতে হয়। বিলম্ব হলে সেইটি আল্লাহর কাছে ঋণ হিসাবে গণ্য হবে। ওশর দারিদ্র্য বিমোচনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ওশর/যাকাত ব্যবস্থাকে গতিশীল করতে পারলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার যাকাত এবং লক্ষ লক্ষ টন ওশর আদায় হবে। ফলে একদিকে দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং অন্য দিকে ইসলামী অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দেশ একদিন সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় পরিণত হবে। সেই সোনালি দিনের প্রতীক্ষায় আমরা রইলাম।
লেখক : ব্যাংকার