বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেছেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত ঠিকই কিন্তু হতাশ নই। রক্তাক্ত ২৮ আমাদের ভীত করে না বরং প্রতি ফোটা রক্তের বদলা নিতে শপথবদ্ধ করে। চিহ্নিত খুনিদের রক্ষা করতে সরকার ক্ষমতার দাপটে মামলা প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু এ সকল অপকৌশলে নিরপরাধ সন্তান হারানো মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদ ব্যর্থ হবে না, রক্তের দাগ মুছে যাবে না। সময়ের পরিবর্তনে খুনি ও নির্দেশদাতাদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি খুন, গুম ও অবিচারের হিসাব আদায় করা হবে। বাংলার সবুজ জমিনে কুরআনের আলোকে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করে শহীদদের প্রতিফোঁটা রক্তের বদলা চূড়ান্তভাবে নেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
সোমবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর আওয়ামীলীগের লগি-বৈঠার পৈশাচিক হামলায় শহীদদের পরিবারের সাথে “মতবিনিময় ও দোয়া অনুষ্ঠান” এ সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় ও দোয়া অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারী এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, শহীদ মাসুমের গর্বিত পিতা মাহতাব উদ্দিন আহমদ, শহীদ হাফেজ শিপনের গর্বিত পিতা মু. তাজুল ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগরী পুর্বের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন খান, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য ও শ্রমিক নেতা আবদুস সালাম, কামাল হোসাইন, অধ্যাপক ড.আব্দুল মান্নান, ২৮শে অক্টোবরের শহীদ মসুম ও শিপনের মাতা, আত্মীয়-স্বজন সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ২৮শে অক্টোবর শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলংকজনক দিন। সেদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিষ্ঠুর গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। প্রকাশ্যে রাজপথে যেভাবে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল তা জাহেলিয়াতের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকেও হার মানিয়েছে। সেদিন তারা জামায়াত ও এদেশের ইসলামী আন্দোলনকে চিরদিনের জন্য দুর্বল ও ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মানব ঢাল তৈরি করে নিজেদের জীবনের কুরবানীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। ২৮শে অক্টোবরের নারকীয় ঘটনার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার যে নীল নকশার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল তা আজও অব্যাহত আছে। এমতাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ ও ২৮শে অক্টোবরের শহীদদের রেখে যাওয়া কাজ বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। শাহাদাতের যজবা নিয়ে দ্বীন কায়েমের প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে। ২৮ অক্টোবরের হত্যাকান্ডে শুধু শোকাহত হলেই চলবে না বরং শোককে শক্তিকে পরিণত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্যাতিত মানুষের সত্যিকারের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
শহীদ মাসুমের পিতা মাহতাব উদ্দিন আহমদ বলেন, আমার ছেলের অপরাধ ছিল সে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতো। ওর নম্রভদ্র ব্যবহারে এই এলাকার প্রতিটি মানুষ তাকে ভালোবাসতো। আমার বন্ধুবান্ধবরা এখনো আমাকে বলে, সত্যি তোমার ছেলে মাসুম ছিলো একটা হিরের টুকরো। সন্তান হারানো বাবা মার কষ্ট বুঝানোর কোনো ভাষা পৃথিবীতে আছে কি না তা আমার জানা নেই। আমার বুকে যে কি কষ্ট তা আমি বুঝাতে পারবো না। তারপরও সব কষ্ট ভুলে যাই যখন ভাবি আমি এক শহীদের পিতা আমার সন্তান জীবন দিয়েছে বাংলাদেশে আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য। শহীদ মাসুমের পিতা বর্তমান সরকারের কাছে তার সন্তান হত্যার বিচার চান। তিনি মনে করেন এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে ব্যর্থ হলে এ জাতিকে ইতিহাস কোনোদিন মাফ করবেনা।
শহীদ শিপনের পিতা তাজুল ইসলাম বলেন, আমার সন্তানদের মধ্যে শিপন ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আমি মনে করি শিপনের শাহাদাত শুধু আমার বুকে সন্তান হারানোর বিয়োগ ব্যাথাই সৃষ্টি করেনি, জাতি হারিয়েছে এক সম্ভাবনাময় তরুণকে। শিপন দাখিল পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১১তম স্থান অর্জন করেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলেও ছিল তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর। শিপন ছিল পবিত্র কুরআনের হাফেজ, সে যখন ওর সমবয়সী বন্ধুদের পবিত্র কুরআন অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ বুঝাতো তখন আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম আর মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতাম। আমার সন্তানকে নির্মমভাবে পিটিয়ে শহীদ করা হয়েছে। আমি চাই আমিও তার মত ইসলামের পথে শহীদ হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন ২৮ অক্টোবরের নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। ভিডিও ফুটেজে খুনীদের ছবি রয়েছে, খুনীরা এখনো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরও কেন সরকার ওদের বিচার করতে পারছে না?
ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, আজ সেই ভয়াল ২৮ অক্টোবর, ২০০৬ সালের এই দিনে রাজধানীর পল্টনে জামায়াত-শিবিরের উপরে পরিকল্পিতভাবে তান্ডবলীলা চালায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মত পিটিয়ে মানুষকে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। সেই তান্ডবে ঢাকার রাজপথে ৬ জনসহ সারা দেশ ১৩ জন জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মী শাহাদাৎ বরন করেন এবং আহত হন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। সাপের মত পিটিয়ে হত্যা ও মৃত লাশের ওপর নৃত্য ও উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের কোটি কোটি বিবেকবান মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে লগি, বৈঠা ও মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যে হত্যাকান্ড ও মানবতাবিরোধী ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল তা দেখে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিবসহ সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে অথচ ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতার বিচার হওয়াতো দূরের কথা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলাই প্রত্যাহার করে নেয়। তিনি অবিলম্বে এই ঘটনার বিচার দাবি করে বলেন, দেশে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্যই এই হত্যাকান্ডের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত এবং বর্তমান সরকার এতে ব্যর্থ হলে এই বাংলাদেশেই কোনো একদিন এই অন্যায়ের সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।
মতবিনিময় ও দোয়া অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে এক আবেগঘন পরিস্থিতির অবতারণা হয়। মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ২৮ অক্টোবর নিহতদের শাহাদাত কবুলের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন এবং শহীদানের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান ও তাদের ধৈর্য্য ধারণের তাওফিক কামনা করেন।