ভূমিকা:
একটি দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী তারাই যাদের সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর থেকে কম। এটা হতে পারে জাতিগত, হতে পারে ভাষাগত আবার হতে পারে ধর্মীয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংখ্যা গরিষ্ঠদের। বাংলাদেশ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত একটি রাষ্ট্র। এর জনসংখ্যা শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। বাকি ৮ ভাগ হিন্দু এবং ২ ভাগ বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও অন্যান্য ধর্মালম্বী। স্বাভাবিকভাবে ধর্মীয় এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অব্যাহত প্রচারণা রয়েছে। এই প্রচারণার বৃহত্তর অংশই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অতিরঞ্জিত। জমি-জমা ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে যেমন- মারামারি ও দাঙ্গা-ফাসাদ রয়েছে তেমনি সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যেও এমনটা ঘটে। অনেক সময় তারা সংখ্যালঘু হিসেবেও নির্যাতনের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ও রাজনৈতিক শক্তিধররা এই নির্যাতন চালায়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে চললেও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষ মদদে বেড়ে চলেছে সংখ্যালঘু নির্যাতন।
বিশেষ করে সাম্প্রাদয়িকতার দোহাই দিয়ে একটি বিশেষ ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জনগণের কাছে দোষী করতে সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্যদের ওপর লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে নির্যাতন করে চলেছে সরকার দলীয় ক্যাডাররা। ভেঙে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি, জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের মুল্যবান সম্পদ। এজন্য বিভিন্ন সময় আল্লাহু আকবার বলে শ্লোগানও দিয়েছে তারা। যাতে করে এই বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ “জামায়াত-শিবিরকে” জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। কিন্তু বর্তমানে সকলের নিকট দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এসব কাজ কারা করছে? এর পাশাপাশি তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্ষণও করেছে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। সংখ্যালঘু নাগরিকদের জমি দখল থেকে শুরু করে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং তাঁদের উপাসনালয়ে হামলাসহ তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অন্যায় অপকর্ম অব্যাহত রয়েছে। অতীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপরে ও তাঁদের উপাসনালয়ে সংঘঠিত হামলার ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়া এবং উক্ত ঘটনাগুলো রাজনীতিকীকরণের কারণে এই ধরনের ঘটনা অব্যাহতভাবেই ঘটে চলেছে। যা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে।
কেবলমাত্র ২০১৫ সালের শেষের দূর্বৃত্তরা বিভিন্ন সময় যেসব হামলা চালিয়েছে, এর কিছু সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর গভীর রাতে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর এলাকার মালিপাড়া দূর্গামন্দিরে লক্ষ্মী প্রতিমা ভাংচুর করে দুবৃর্ত্তরা । (মানবজমিন, ৭ নভেম্বর, ২০১৫)।
২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নের কোটগাঁও গ্রামের কৈবর্তপাড়ায় লক্ষ্মী প্রতিমা ভাঙচুর।
২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর, ঢাকা জেলার সাভার পৌর উত্তরপাড়া সার্বজনীন শ্রী শ্যামা পূজা মন্দিরে হামলা। (যুগান্তর, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫)।
২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ফরিদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অলোক সেনকে কুপিয়ে যখম। (প্রথম আলো- ২৫ নভেম্বর, ২০১৫)।
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বরবগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চককানু গ্রামে মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে হামলা।
২০১৫ সালের ২৫ শে নভেম্বর রংপুরে ধাপ এলাকার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান ব্যাপ্টিস্ট চার্জ সংঘের ফাদারমি. বার্নবাস ও দিনাজপুর জেলা সদরের উত্তরপাড়ার গণেশ রায়ের পুত্র অতুল রায়কে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। একই দিনে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার ক্যাথলিক চার্চের ফাদার কার্লসকে তাঁর মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
এর পাশাপাশি সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ মদদে নির্যাতিত হয়ে চলেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এর কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো :
স্থানীয় যুবলীগ কর্মীর প্রশ্রয়ে বরগুনার তালতলী উপজেলার পঁচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের উত্তর গাববারিয়া গ্রামে প্রভাবশালীরা ১৪ হিন্দু পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পেছনে গ্রামের হাকিম আলী সরদারের ছেলে যুবলীগকর্মী জাকির হোসেন ও তার ভাই আবদুস সালাম রয়েছেন।
১১ এপ্রিল ২০১৫ শনিবার রাতে সরকার দলীয় ক্যাডাররাসিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পৌরশহরের ঝিকিড়া কালী মন্দিরে হামলা চালিয়ে ১০টি মূর্তি ভাঙচুর করে।
২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোরে নীলফামারীতে জেলার ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের কাকিনা চাঁপানী সার্বজনীন পুরাতন দুর্গামন্দিরে আগুন দিয়ে হিন্দুদের হুমকি দিয়ে জামায়াতের নামে পোস্টার টাঙায় সরকার দলীয় কর্মীরা।
২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস মালিপাড়া মন্দিরে মুখোশ পরে রাতের আধাঁরে হামলা করতে গিয়ে জনতার গণধোলাই খেয়ে প্রাণ হারায় ছাত্রলীগ কর্মী সাদ্দাম।
মাগুরা সদর উপজেলার আঙ্গারদাহ গ্রামেঅবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অখিল চন্দ্র বিশ্বাস ও তার পরিবারের ৫৭ শতক জমি জোরপূর্বক দখল করে প্রভাবশালীরা। এদের বেশীর ভাগই সরকারী মদদ পুষ্ট।
বিয়ের প্রলভন দেখিয়ে এক হিন্দু নারীকে ধর্ষন করেন ঢাকার ধামরাই এর সোয়াপুুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ধামরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুর রহমান। মামলা দায়ের করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের এক শিশুকে ধর্ষন করেন যুবলীগের সদর উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়ন যুবলীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শামছুল মিয়া চৌধুরী।পরে তাকে জনসাধারণ গণ পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
সংখ্যালঘু অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষনে মুসলিমদের অপরিহার্য্য করনীয়ঃ
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম দেশে যে সমস্ত অমুসলিম বসবাস করেন তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব উক্ত মুসলিম দেশের নাগরিকদের, হোক সেটা নাগরিক অধিকার, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অধিকার।
১. অমুসলিম নাগরিকদের উপর কোন প্রকার নির্যাতন করা যাবে না। কেননা, তারা আমাদের দেশে সকলের মত সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা প্রাপ্ত।
২. তারা দেশের জনগণের একটা অংশ বিশেষ। সুতরাং মুসলমানদের দায়িত্ব হয়ে যায় তাদের কাছ থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে নেয়া। অন্য কথায় বলতে গেলে তাদেরকে রক্ষা করা ও নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব এসে যায় মুসলমানদের উপর। হযরত উমার (রাঃ) তাঁর পরবর্তী খলীফার প্রতি ওসিয়ত করে গেছেন যে, মুসলমানরা যেন তাদের (অমুসলিম নাগরিকদের) হক তথা অধিকারকে পুরোপুরি পরিশোধ করে দেয় এবং তাদেরকে আগলে রাখে।
৩. অমুসলিমদের উপাসনালয়ের উপর হস্তক্ষেপ না করা। কেননা, নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকারও ব্যক্তিগত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। (আহকামুয যিম্মা ফিল ইসলাম) তবে তারা মুসলিমদের মাঝে তাদের ভ্রান্ত মত প্রচার করতে পারবে না। তাদেরকে জোর করে ইসলামে টেনে আনা যাবে না। কেননা, ইসলাম ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িকে একেবারেই সাপোর্ট করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, দ্বীন তথা ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণের বেলায় কোন জবর দস্তি নেই। (সুরা বাকারা:২৫৬)
মূলত দু’টি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা করতে বলেঃ
১. মতাদর্শ গত দৃষ্টিভঙ্গিঃ
ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, বরং এমন একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা জীবনের সব বাস্তব সমস্যার সমাধান দেয়। যেমন যেকোন সেক্যুলার পূঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করে তেমনি ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও সব ধর্মের জনসমষ্টি বসবাস করতে পারে। এই রাষ্ট্র শক্তিশালী হওয়ার লক্ষ্যেই তার নিজস্ব ভূখন্ডের সকল ধর্মমতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের আভ্যন্তরীণভাবে দৃঢ় ও সংহত করবে। আল্লাহ্ বলেন,“তাছাড়া তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে।” (আল-আনফালঃ ৪৬) । সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থাধীন রাষ্ট্রের শক্তি-সমৃদ্ধি সমুন্নত রাখতে মুসলিম- অমুসলিম সম্প্রীতি তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা অপরিহার্য।
২. মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ
ইসলাম মানুষের প্রত্যেকটি সমস্যাকে মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। মানুষের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন বোঝা ইসলাম তাদের উপর চাপিয়ে দেয় না। এটি কোন মানুষের মন গড়া কোন ধর্ম নয় বরং এ হচ্ছে মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ (সুবাঃ) প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা কোন একক সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর জন্য নয়। বরং এ হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য। ইসলামের শ্বাশত ও সার্বজনীন বাণী নিয়ে যাঁকে প্রেরণ করা হযয়েছে, সেই সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন, “আপনি বলুন; হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদের সকলের কাছে আল্লাহর প্রেরীত রাসূল। সমগ্র আসমান ও যমীনে যার রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন।” (সূরা আরাফ-১৫৮)। উপরোক্ত আয়াতটি গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যা শুধুমাত্র মুসলমাদের উদ্দেশ্যে নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিধান প্রদানকারী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দৃষ্টিতে বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তিনি বলেন, “হে মানবগোষ্ঠী! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক মুত্তাকী।” (সূরা হুজরাতঃ১৩)।
সুতরাং ইসলামের আগমনই হয়েছে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও প্রবৃত্তির দাবীগুলো পূরণ করা সকলের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য। ইসলাম এক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিমের কোন ভেদাভেদ নির্ণয় করেনি। ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিমদের যে অধিকারগুলো বিশেষভাবে বাস্তবায়ন করে তা হচ্ছে :
খাদ্য-বস্তুর-বাসস্থানের অধিকার,
রাজনৈতিক অধিকার,
বিশ্বাসের অধিকার,
সামরিক অধিকার
জান-মালের নিরাপত্তার অধিকার,
বিচার প্রাপ্তির অধিকার,
শিক্ষার অধিকার,
অর্থনৈতিক অধিকার,
নাগরিক ও সামাজিক অধিকার।
ইসলামী রাষ্ট্র এর অধীনে বসবাসকারী প্রত্যেকটি নাগরিক এই সবগুলো অধিকার ভোগ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে মুসলিম অমুসলিম নাগরিকগণের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্র কোনরূপ পার্থক্য করে না।
সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষনে ইসলাম যা বলে
ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত একটি মুসলিম দেশে ইসলাম মুসলমানদেরকে শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতেই বলে না, রাষ্ট্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ এর একাধিক স্থানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার তুলে ধরা হয়েছে। অমুসলিমরা নিজ নিজ উপাসনালয়ে উপাসনা করবেন। নিজ ধর্মবিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখবেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা সমান। তাদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ইসলাম বরদাশত করে না। যেসব অমুসলিমের সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই, যারা শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের সঙ্গে বসবাস করেন তাদের প্রতি বৈষম্য দেখানো নয় বরং ইনসাফ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয়নি। নিশ্চয়আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। {সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত : ৮}।
মহান আল্লাহ ঈমানের দাবীদার প্রতিটি মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা পরমতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। তিনি বলেন,‘তারা আল্লাহর বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে’। {সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ১০৮}। অমুসলিমদের উপসনালয়ে সাধারণ অবস্থায়তো দূরের কথা যুদ্ধাবস্থায়ও হামলা করা যাবে না। কোনো পুরোহিত বা পাদ্রীর প্রতি অস্ত্র তাক করা যাবে না। কোনো উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেওয়া যাবে না। হাবীব ইবন অলীদ থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা) কোথাও সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন,‘আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয়নি। নিশ্চয়আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। {সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত: ৮}।
আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবিদার প্রতিটি মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। তিনি বলেন,
‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াাবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’ [মুসলিম : ১৭৩১]
আরেক হাদীসে আছে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসুল (সা) নিজের কোনো বাহিনী প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’ [ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের হত্যা করা নিষেধ অধ্যায়]
আবূ বকর (রা) একই পথে হাঁটেন। আপন খিলাফতকালে প্রথম যুদ্ধের বাহিনী প্রেরণ করতে গিয়ে তিনি এর সেনাপতি উসামা ইবন যায়েদ (রা) উদ্দেশে বলেন,
‘হে লোক সকল, দাড়াও আমি তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দেব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। কোনো খেয়ানত করবে না, বাড়াবাড়ি করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, (শত্রুদের) অনুরূপ করবে না, ছোট বাচ্চাকে হত্যা করবে না, বয়োবৃদ্ধকেও না আর নারীকেও না। খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়ে দেবে না। কোনো ফলবতী গাছ কাটবে না। আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই করবে না। আর তোমরা এমন কিছু লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে যারা গির্জাগুলোয় নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তোমরাও তাদেরকে তাদের এবং তারা যা ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের জন্য তাতে ছেড়ে দেবে। [মুখতাসারু তারীখি দিমাশক : ১/৫২; তারীখুত তাবারী]
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন,‘যে মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় ৪০ বছরের পথের দূরত্ব থেকে’। [বুখারী : ৩১৬৬]
ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের দীর্ঘ ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা) সমাজ ও রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিযয়েছেন। তিনি মাতাপিতার হক, সন্তান-সন্ততির হক, আত্মীয়-স্বজনদের হক, অনাথ ও দরিদ্রদের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসাফিরের হক, চলার পথের সঙ্গী বা পথচারীর হক, দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানীর হক এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের হক সম্পর্কেও নির্দেশনা দিযয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে মুসলিমদের কাছে অমুসলিমদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিমদের তিনি অমুসলিমদের নিরাপত্তা দানের নির্দেশ দিয়েছেন।
উপসংহারঃ
বর্তমান প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হওয়া সত্বেও এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে। এর অন্যতম কারণ এখানে আল্লাহর দেওয়া বিধান প্রতিষ্ঠিত না থাকা। বর্তমান সরকার যেমন একের পর এক ইসলাম বিরোধী নীতি বাস্তবায়ন করে চলেছে তেমনি অসাম্প্রদায়িক পরিচয় দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে চলেছে। জাতীয় ও আন্তজার্তিক মদদে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ এর অপব্যাখ্যা করে সৃষ্টি করা হয়েছে জঙ্গিবাদ। যার দোহাই দিয়ে গোটা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। প্রণিত হয়েছে এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যাতে গোটা মানব সমাজ প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। খুন, রাহাযানী, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ঘুস- দূর্নীতি, মাদকতা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে লাগামহীনভাবে। সরকার দলীয় ক্যাডারদের স্বেচ্ছাচারী তৎপরতায় বিপন্ন হচ্ছে মানবতা। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যা লঘিষ্ঠ উভয় জনগোষ্ঠীকেই। সুতরাং, এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে প্রচলিত নিপীড়নমুলক ও স্বেচ্ছাতন্ত্র পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী বিধান প্রণয়নের পদক্ষেপ ক্রমেই সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।