মুহাম্মদ কামারুজ্জামান একটি নাম, একটি আন্দোলন ও একটি বিষ্ময়কর প্রতিভা। যুগ নয়, শতাব্দীর ক্ষণজন্মা ইসলামী আন্দোলনের এক অগ্রসেনানী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সেরা মেধাবী ছাত্র তিনি। যিনি একাধারে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। মেধাবীদের সাহসী ঠিকানা শহীদী কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত একটি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হিসেবে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন সে আন্দোলনের সিপাহসালারের। তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এদেশের মানুষ সমাজ, সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের নানা অসঙ্গতির ইতিহাস জানতে সক্ষম হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লড়াইয়ে তিনি অন্যতম। দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনারে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা সেক্যুলার ও বামপন্থীদের ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে জিঘাংসা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই শুরু হয় হত্যার পরিকল্পনা। রাজনীতিতে জনাব কামারুজ্জামান সাহচর্য লাভ করেছেন মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শীতা অর্জনে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। মূলত যারা আদর্শের লড়াইয়ে পরাজিত তারাই ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চায়। হত্যা, গুম, অপহরণ এবং বিচারের নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যার ভিন্ন অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলী ও নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয়েই প্রতিপক্ষরা তৈরি করছে তাঁকে হত্যার গভীর নীল নকশা ।
পৃথিবীর সকল নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যার পর আবার জনাব কামারুজ্জামানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সদালাপী প্রাণপুরুষ। আজকের এই মুহূর্তে বিশ্বের কোটি- কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর অশ্রুশিক্ত চোখে জায়নামাজ ভাসাচ্ছে এই প্রিয় মানুষটির জন্য। আজ যেন হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে মানবাধিকার, সত্যপন্থা, কল্যাণ, সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতিককে। কলুষিত করা হচ্ছে সত্য, সুন্দর, বিনয়, নম্রতা আর ভদ্রতাকে। জনাব কামারুজ্জামান নিজেই তাঁর দীর্ঘ সাফল্যমন্ডিত কর্ম, বুদ্ধিদীপ্ত পথের আবিষ্কারক। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান যেমন একদিকে সফল রাজনীতিবিদ ও সংগঠক অন্যদিকে একজন সফল সাংবাদিক ও সম্পাদক। তারই সফল সম্পাদনা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা আজ পরিচিত নাম।
রাজনৈতিক ময়দানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলন, গণতন্ত্র ও তার বিকাশ, নির্বাচন, গণমাধ্যম, সমাজ সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর চিন্তা ও গবেষণা করে চলেছেন। তিনি বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও তার কৌশল নিয়ে বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেই বইগুলো পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম ইনসান আলী সরকার ও মাতা মরহুমা সালেহা খাতুন।
তিনি কুমরী কালিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার পর শেরপুর জিকেএম ইন্সটিটিউশনে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বরাবরই প্রথমস্থান অধিকার করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে তিনি আবাসিক বৃত্তি পান। ১৯৬৭ সালে জিকেএম ইন্সটিটিউশন থেকে ৪টি বিষয়ে লেটারসহ এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং আবাসিক বৃত্তি লাভ করেন। পুরো শেরপুরে একজন ভাল ছাত্র হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছাত্রজীবন হতেই একজন বিনয়ী ভদ্র অমায়িক মানুষ হিসেবে সর্বজনবিদিত। ১৯৬৭-৬৯ সেশনে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু দেশে ’৬৯-এর গণআন্দোলন শুরু হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৭১ (১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত) সালে মোমেনশাহী নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে কৃতিত্বের সাথে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন।
জননেতা কামারুজ্জামান ১৯৭৭ সালে নুরুন্নাহারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৫ সন্তানের জনক। তারা হলেন হাসান ইকবাল ওয়ামী, হাসান ইকরাম ওয়ালী, হাসান জামান ওয়াসী, হাসান ইমাম ওয়াফী, আহমদ হাসান সাফী।
ছাত্র রাজনীতি: শেরপুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব মরহুম কাজী ফজলুর রহমানের আহ্বানে জিকেএম ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। কলেজে পা দিয়েই তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি এবং পরে সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং একমাস পরই নির্বাচনের মাধ্যমে সেশনের বাকি সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৮৯ সালেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন।
বিশ্ব মুসলিম যুব সংস্থা (ওয়ামী) এবং বাংলাদেশ সরকারের যুব মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে মৌচাক স্কাউট ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক ইসলামী যুব সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে তিনি প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন শেরপুরের আরেক কৃতী সন্তান মরহুম খন্দকার আব্দুল হামিদ।
উল্লেখ্য, এই সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন।
ছাত্রশিবির ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান: বিশ্বের ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এক গৌরভ গাঁথার নাম। কিন্তু এর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের নামটি। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি এবং পরে সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং একমাস পরই নির্বাচনের মাধ্যমে সেশনের বাকী সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৭৯ সালেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পুন:নির্বাচিত হন।
সাংবাদিকতা: ছাত্রজীবন শেষে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলা মাসিক ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তাকে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মাত্র ১ জন পিয়ন ও ১ জন কর্মচারী নিয়ে যাত্রা শুরু করে সোনার বাংলা। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোনার বাংলায় ক্ষুরধার লেখনীর কারণে এরশাদের শাসনামলে পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। ‘সোনার বাংলা’ রাজনৈতিক কলাম ও বিশ্লেষণ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পত্রিকাটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সাপ্তাহিকের মর্যাদা লাভ করে। কারাগারে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কতিপয় ব্যক্তির সহযোগিতায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নতুন পত্র’ প্রকাশ করেন, অবশ্য এ পত্রিকাটির প্রকাশনা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দশ বছর দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জাতীয় প্রেস ক্লাবের একজন সদস্য এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান: পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৯৭৯ সালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন, একই বছর তিনি জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমিটি ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে বিগত স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৯৮৩-৯০ পর্যন্ত তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৩-৯৫ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতের নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় পর গঠিত চারদলের কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য প্রচেষ্টায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এজন্য দলীয় রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন ফোরামে সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার সক্রিয় উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
বিদেশ ভ্রমণ: জননেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইরান, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, হংকং, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, আস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইতালী, জার্মানী, তুরস্ক, ইয়ামেন, ব্রুনাই, বাহরাইন ও কুয়েত।
লেখক কামারুজ্জামান: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দেশী বিদেশী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কলাম লিখতেন। পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার লিখিত বইগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব, পশ্চিমা চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম, বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইসলামী আন্দোলন, সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম, সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসী ইত্যাদি।
শেরপুরের জনগনের ম্যান্ডেট:১৯৮৬ সাল থেকে শেরপুর সদর তথা শেরপুর-১ আসনে জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রতিদ্বন্তিতা করে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে আসছেন।সর্বশেষ দুটি সাধারন নির্বাচনে(২০০১ ও ২০০৮) তিনি খুব অল্প ভোটের ব্যাবধানে হেরে গেলেও ধারনা করা হয় তিনিই প্রকৃত বিজয়ী। কারণ,ঐ দুই নির্বাচনেই আওয়ামীলীগ প্রার্থী তার নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকার ভোট কেন্দ্রগুলো দখল করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নেন।এত কিছুর পরও ২০০১ এর নির্বাচনে কামারুজ্জামান ৬৫,৪৯০ ভোট (বিজয়ী আওয়ামী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৮৬,১০১)এবং ২০০৮ এর ডিজিটাল নির্বাচনে ১,১০,০৭০ ভোট পান (বিজয়ী আওয়ামী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ১,৩৬,১২৭)। ১৯৭১ সালে শেরপুরের নারকীয় ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী মানুষগুলো বেঁেচ থাকতে শহীদ কামারুজ্জামানকে এত বিপুল ম্যান্ডেট দেয়া কি কোন অর্থ বহন করে না?
চার্জে আনীত অভিযোগের ঘটনাস্থলসমূহ শেরপুর-এখানকার মানুষগুলো দেখে-শুনে- বিগত ৪০ বৎসর ধরে যা জেনে এসেছে;সেখানে যদি কামারুজ্জামানের সংশ্লিস্টতা থাকত, তাহলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার এমন গণরায় কি সম্ভব?
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মেয়ের জামাই:মুক্তিযুদ্ধের সময় গৌরবময় ভূমিকা পালনকারী পরিবারের মেয়েজামাই মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্বা সংসদের নির্বাচিত বর্তমান জেলা কমান্ডার-অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এ জি এম ’৭১ এর রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম হিরুর ছোট বোন মিসেস নুরুন্নাহার জনাব কামারুজ্জামানের সহধর্মিণী। আনোয়ার হোসেন মন্জু (সম্বন্ধী) স্বনামধন্য অনুবাদক, বাসসের সাবেক চিফ রিপোর্টার, সাবেক বার্তা সম্পাদক : দৈনিক বাংলার বাণী (শেখ ফজলুল হক মনি প্রতিষ্ঠিত ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম এম পি সম্পাদিত-এক সময়ে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত), বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। আবুল কালাম আযাদ (শ্যালক) ২ বারের ইউ পি চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছোট শ্যালক মনোয়ার হোসেন বাবুল একজন কৃষিবিদ ও সফল ব্যবসায়ী। শ্বশুর জনাব আজিজুর রহমান ১৯৭১ সালে কৃষি অধিদপ্তরে চাকরি করতেন, যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্বাদের আশ্রয় দিতেন, খাবার দিতেন, সবরকমের সহযোগিতা করতেন। শেরপুরের সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কামারুজ্জামান যদি সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুতর অপরাধে অপরাধী হতেন তাহলে কি ১৯৭৮ সালে এমন একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে বিয়ে করতে পারতেন।
বিচারিক কার্যক্রম: ২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৬ জুন আপিল করেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। গত বছরের ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে আপিলের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন তার আইনজীবীরা। এরপর ৩ নবেম্বর আপিল বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আদেশে রায় ঘোষণা করেন।
২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর ১৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়। ১৬ মে ডিফেন্সপক্ষ এবং ২০ মে প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন। এরপর ২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের ১৮ জন সাক্ষ্য দেন। অন্যদিকে কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০১৩ সালের ৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ৫ জন ডিফেন্স সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন মো. আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয় সুপ্রিম কোর্টের ফটক থেকে। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
রিভিউ আবেদন খারিজ: ৬ এপ্রিল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন খারিজ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সংক্ষিপ্ত আদেশে আপিল বিভাগ বলেছেন ‘ডিসমিসড’। এর ফলে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ আগে যে রায় দিয়েছিল তা বহাল থাকে। পাশাপাশি শেষ হয় মামলার বিচার কার্যক্রমও। সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অন্তত সাত দিনের সুযোগ থাকলেও ওইদিনই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি কয়েক ঘণ্টার মাত্র। অথচ অন্যান্য মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে কারা আইনে ‘৭ দিনের আগে না, আবার ২১ দিনের পরে না’-এমন বিধান আছে। এ মামলার ক্ষেত্রে ওই আইন প্রযোজ্য হবে না বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী। আগেরদিন রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ শেষে আদালত সোমবার (৬ এপ্রিল) আদেশের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন।
গত সোমবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ আদেশ দিয়ে বলেন, রিভিউ আবেদন ‘ডিসমিসড’।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদনের শুনানি করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি সিনিয়র এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাকে সহায়তা করেন এডভোকেট মুহাম্মদ শিশির মনির।
মৃত্যু পরোয়ানা জারি: গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীসহ চারজন কামারুজামানকে পরোয়ানা পড়ে শোনান। আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের রায় অনুযায়ী, দন্ডিতদের জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ পান। এই রায়ের ভিত্তিতে গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তার আইনজীবীরা ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে রিভিউ আবেদনটি দায়ের করেন। ৪৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে মোট ৭০৪ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট ছিল।
যে কারনে মৃত্যুদন্ডাশের বিরোধীতা করলেন এক বিচারপতি:গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় সাড়ে তিনমাস পর প্রকাশ হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির স্বাক্ষর শেষে রায়টি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। পূর্ণাঙ্গ রায়টি ৫৭৭ পৃষ্ঠার। রায়ের ৫৭৬ পৃষ্ঠায় ছিল সংক্ষিপ্ত আদেশ। পূর্ণাঙ্গ রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছে- আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর হলো। আপিলকারী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে প্রথম অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হলো। ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগে তার দন্ড সংখ্যারিষষ্ঠতার ভিত্তিতে বহাল থাকলো। ৩ নম্বর অভিযোগে তাকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হলো তবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। ৪ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তার সাজা মৃত্যুদন্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হলো।
আপিলের রায়ে জ্যোষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ে বলেন, আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর হলো। ২, ৪ এবং ৭ নম্বর অভিযোগে আপিলকারী দোষী না হওয়ায় (মুহাম্মদ কামারুজ্জামান) খালাস দেয়া হলো। ৪ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যৃদন্ডের স্থলে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হলো। ২ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে ব্যর্থ। কারণ দোষী প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো। ৩ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের আদেশ সংশোধন করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ ঘটনাস্থলে অভিযুক্তের উপস্থিতি নিয়ে কিছুটা সন্দেহ রয়েছে। ৪ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ,প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, এই অভিযোগটিও প্রসিকিউশন সন্দেহাতীত প্রমাণ করতে পারেনি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন ‘কামারুজ্জামান কোনো কোনো দিন সকালে, কোনো কোনো দিন দুপুরে আবার কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পর ডাক বাংলোর ক্যাম্পে আসতো। যদি তাই হয় তাহলে কিভাবে অভিযুক্ত প্রণিধানযোগ্য আল বদর নেতা হলেন? কিভাবে সাক্ষীরা তাকে দেখেছে এবং ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ বিষয়গুলো আরো বিস্তারিত ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা নিতে পারতো। তাই অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হলো।
রাষ্ট্রপতি জীবন দেয়ার ও নেয়ার মালিক নন যে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবো: মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে ১১ এপ্রিল শনিবার বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাৎ শেষে তার ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী বলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়া প্রসঙ্গে বাবা বলেছেন, প্রাণের মালিক আল্লাহ। রাষ্ট্রপতি জীবন দেয়ারও মালিক নন নেয়ারও মালিক নন যে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবো। তিনি বলেন, বাবা বিচলিত নন, আমরা হাসিমুখে বিদায় দিয়ে গেলাম। তার সাথে কোন ম্যাজিস্ট্রেট দেখা করেননি বলেও জানান মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। গত
বের হওয়ার সময় বড় ভাই কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আমার ভাই বলেছেন, তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চওয়ার প্রশ্নই উছে না। ক্ষমা চাইবেনতো শুধু আল্লাহর কাছে। তিনি বলেন, আমার বাবার স্বপ্ন ছিল এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বেই এদেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।তিনি বলেন, তার বাবা বলেছেন, তার সাথে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। ১৮ বছরের একজন কিশোরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বিচারের ভার তিনি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবার মনোবল দৃঢ় আছে। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বাবা বিচলিত নন, আমরা হাসিমুখে বিদায় দিয়ে গেলাম।
উপেক্ষিত জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিদের আহ্বান
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচার ও মৃত্যুদন্ড সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। ত্রুটিপূর্ন বিচার প্রক্রিয়ার কারনে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর না করতে আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের তা উপেক্ষা করে শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে হত্যা করে।
জাতিসংঘ : মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত রাখতে আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ। বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষে স্পোকসম্যান রাভিনা সামদানী এ আহ্বান জানান।জেনেভা থেকে দেয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড স্থগিত করতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কামারুজ্জামান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন। তার বিচার প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম বিদ্যামান ছিল এবং ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস দীর্ঘদিন যাবত বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল, তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা। ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ১৬টি রায় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, যার অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দল-জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতা। তারা সবাই ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধ, গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে দন্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত ইন্টারন্যাশনাল কভোন্যান্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইট্স এর উদ্বৃতি দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া বিচারের ক্ষেত্রে বিবেকী ন্যায্য বিচারের নিশ্চয়তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যদি অন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে মৃত্যু- কার্যকর করা হয়, তা হবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘ সব সময়ই মৃত্যুদন্ডের বিরোধী, এমনকি যেখানে কঠোরভাবে ন্যায্য বিচারের মানদন্ড অনুসরণ করা হয়েছে এবং অধিকাংশ গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সে ক্ষেত্রেও।বিবৃতিতে অমানবিক মৃত্যুদন্ডাদেশ বিলোপকারী দেশের কাতারে শামিল হতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ইইউ: মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড বহাল থাকায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ঢাকায় অবস্থিত সংস্থাটির কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে ওই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাজা হিসেবে মৃত্যুদন্ড কখনোই অপরাধ দমন করতে পারে না। বরং এতে বিচারের উদ্দেশ্য সফল হয় না। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যে কোনো ধরনের মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিবৃতিতে জানায়, এ ধরনের সাজা বৈশ্বিকভাবে বিলুপ্তির জন্য ইইউ ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে, মৃত্যুদন্ডের মতো সাজা স্থগিত করা হোক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ায়’ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড স্থগিতের আহ্বান জানায়। এইচআরডব্লিউ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবিলম্বে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডের রায় স্থগিত করা এবং মামলাটি স্বাধীনভাবে পুনর্বিবেচনা না করা পর্যন্ত তা কর্তৃপক্ষের মুলতবি রাখা উচিত।
এতে বলা হয়, ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেয়, যার অর্থ তিনি আসন্ন মৃত্যুদন্ডের সম্মুখীন।
এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, মৃত্যুদন্ড একটি অপরিবর্তনযোগ্য ও নিষ্ঠুর শাস্তি। বিচার বিভাগ যখন এ ধরনের শাস্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গরূপে পুনর্বিবেচনা করতে ব্যর্থ হন, তখন সেটি আরও গর্হিত পর্যায়ে উপনীত হয়। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার কাজ নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া লঙ্ঘনের পুনঃপুনঃ ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের মহামারীতে বিপর্যস্ত, যেখানে পক্ষপাতহীন বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা আবশ্যক।
গত সোমবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ‘বাংলাদেশ: সাসপেন্ড ডেথ সেনটেন্স অব ওয়ার ক্রাইমস অ্যাকিউজড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানানো হয়।
ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ১৯৭১ সালে ভয়াবহ যেসব যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দীর্ঘকাল থেকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। কিন্তু, এ বিচারসমূহ আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার মানদন্ডে হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ন্যায়বিচার প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ মানদন্ডের নীতিতে অবিচল থাকা আবশ্যক, বিশেষ করে জীবন যখন বিপন্নপ্রায়। তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাতে সে মানদন্ডসমূহ অনুসরণ করা হয়েছে, তেমনটা বলা যায় না।
একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবিলম্বে মৃত্যুদন্ড স্থগিত করার দীর্ঘদিনের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠনের মতে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে মৃত্যুদন্ড সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ব্র্যাড অ্যাডামস আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত আইন কার্যকরের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড স্থগিত করা এবং যে রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই এ ধরনের বর্বরোচিত রেওয়াজের বিলোপ ঘটিয়েছে, অচিরেই তাদের সঙ্গে যোগ দেয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) নির্দেশে ২০১০ সালের জুলাইয়ে কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠন করা হয় আইসিটি। ওই যুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু, জামায়াতে ইসলামীর এ নেতাকে কেন গ্রেফতার করা হলো, সে সম্পর্কে তাকে কোন কারণ জানানো হয়নি। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন’ তার গ্রেফতারকে বিধিবহির্ভূত ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করে। বিচার চলাকালীন সময়ে বিধিবহির্ভূতভাবে আসামী পক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগকে সীমিত করে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও নথিপত্র উপস্থাপনেও এ সীমাবদ্ধতা কার্যকর ছিল। এভাবে কামারুজ্জামানের বিচার প্রক্রিয়ার আরও কয়েকটি অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয় এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে।
লর্ড কারলাইল: যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ড এর সদস্য লর্ড কারলাইল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড স্থগিত করাসহ সরকারের প্রতি ৫ দফা সুপারিশ করেন। তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে স্বাধীন তদন্ত করা, তা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় সকল কার্যক্রম স্থগিত, সর্বোচ্চ দন্ড হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান স্থগিত রাখাসহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।বিবৃতিতে তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া ছিল না। আশা করা হয়েছিল রিভিউ গ্রহণ করে ত্রুটিগুলো দূর করা হবে এবং পুনঃবিচারের আদেশ দেয়া হবে।তিনি বলেন, বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ, নো পিস উইদাউট বর্ডার, জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অরবিট্রারী ডিটেনশন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বিচার বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সমালোচনা করেছে। এই বিশেষজ্ঞদের কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। তারা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে চায়।
কমনওয়েলথ ল’য়ার এসোসিয়েশন : মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে কমনওয়েলথ ল’ইয়ার্স এসোসিয়েশন-সিএলএ। এ সংস্থা সরকারের প্রতি ৪ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হলো, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দেয়া সকল সাজা ও বিচার কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করা, অনতিবিলম্বে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া রিভিউ এবং তদন্ত করা, সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান স্থগিত রাখা, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি এর কার্যক্রম দেশীয় আইন যেমন নয়, তেমনি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ীও হচ্ছে না, যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বিধিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। পুরো বিচার প্রক্রিয়াতেই তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
লর্ড এভিব্যুরির চিঠি: প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কাছে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ড-এর সদস্য লর্ড এভিব্যুরি। গত সোমবার দেয়া চিঠিতে তিনি বলেন, আমি জানি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে করা রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে এবং তা কার্যকর করা হবে।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আইনজীবী সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে। চিঠিতে তিনি আরো বলেন, আমি কি মৃত্যুদন্ডকে আমৃত্যু কারাদন্ডে পরিবর্তন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুপারিশ করতে আপনাকে অনুরোধ করতে পারি? আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, এর আইনী প্রক্রিয়ায় ত্রুটি নিয়ে, বিশেষ করে মি. কামারুজ্জামান যে অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন, তার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অনুপস্থিতি। যদি তার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়, তা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমার্যাদা ক্ষুন্ম করবে।
জীবনের শেষ মুনাজাত: ১১ এপ্রিল পরিবারের সদস্যরা শেষ দেখা করতে গেলে তাদের নিয়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কেন্ত্রীয় কারাগারে মোনাজাত করেন বলে তাকে দেখা করতে যাওয়া ২১ জন সদস্যের একজন প্রকাশ করেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ। কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছিলাম, হাসি মুখেই বিদায় জানিয়ে আসলাম প্রিয়জন প্রিয় নেতাকে। আমার দু চোখ, আমার হৃদয় সৌভাগ্যবান। আমি তাকে কাঁদতে দেখিনি, বরং আমাদের কেই সান্ত¡না দিয়েছেন। উনি যখন বিদায় বেলায় আমাদের কে নিয়ে মোনাজাত করছিলেন বলছিলেন, হে আল্লাহ আমি দেশের জন্য কাজ করেছি ইসলামের জন্য কাজ করেছি যারা এই অন্যায় বিচার করলেন, এই বিচারে সহযোগিতা করেছে এদের বিচার আপনি দুনিয়াতে এবং আখিরাতে উভয় জায়গায় করেবেন। আমি আমার দুই হাত দিয়ে কোন অন্য কাজ করিনি আমার মুখ দিয়ে কাওকে গালি দেইনি আমার সম্পর্কে আপনি ভালো জানেনআপনি আমাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। আমার পরিবার, স্বজনসহ সকলকে ধৈর্য ধারাণ করার তৌফিক দিন,উনি শেরপুরসহ দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীকে সালাম জানিয়েছেন। সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন।”
জান্নাতের পথে: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নামে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে গত এপ্রিল রাত রাত ১০টা ৩০ মিনিটে হত্যা করা হয়। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
শেরপুরে চির নিন্দ্রায় শায়িত শহীদ কামারুজ্জামান: শেরপুরে নিজের গড়া এতিমখানার পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হলেন শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। দাফনের পর থেকেই কবর জিয়ারতের জন্য নামে মানুষের ঢল। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গতকাল রোববার ভোরে শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জমানকে দাফনের পর বেলা বাড়ার সাথে সাথেই হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করতে আসছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন কামারুজ্জামানের রূহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করছেন। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার নিজের গড়া শেরপুর সদর উপজেলার কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানার পাশেই তার লাশ দাফন করা হয়। গতকাল রোববার ভোর ৫টা ২০ মিনিটে দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে রোববার ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে এতিমখানা মাঠে তার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কামারুজ্জামানের আত্মীয়সহ স্থানীয়রা অংশগ্রহণ করেন। আশেপাশে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। দাফনস্থলে গণমাধ্যম কর্মীসহ স্থানীয় এলাকাবাসীর প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল।
গত শনিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে সরেজমিনে জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কুমরী বাজিতখিলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়। রোববার ভোর ৪টা ১৬ মিনিটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের লাশ কুমরী বাজিতখিলা গ্রামে এসে পৌঁছে। এ সময় তাঁর বড় ভাই মো. কফিল উদ্দিন লাশ গ্রহণ করেন। পরে কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানা মাঠে অনুষ্ঠিত নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন বাজিতখিলা দাখিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার ও কামারুজ্জামানের ভাগ্নি জামাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ।
রোববার ভোর ছয়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা শিথিল করলে কামারুজ্জামানের কবরস্থানে হাজার হাজার নারী-পুরুষের ঢল নামে। তাঁরা কামারুজ্জামানের রূহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। এ সময় শোকে কাতর এলাকাবাসীর আহাজারিতে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এলাকাবাসীর মাতম দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যের চোখও অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। দিনভরই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকে কবর জিয়ারত করার জন্য।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সারারাত প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তার গ্রামের বাড়ির পাঁচ বর্গ কিলোমিটারের বাইরে হাজার হাজার মানুষ রাতভর অপেক্ষা করেও জানাযায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। এমনকি ঢাকা থেকে লাশের সাথে যাওয়া গণমাধ্যম কর্মীরাও স্থানীয় বাজিতখিলা বাজারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকেছিলেন। রাতে ওই এলাকায় প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হয়। পুরো এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ভোর ৪টার দিকে বিদ্যুৎ আসলেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। তারপরও জনসমাগম কমেনি।
কামারুজ্জামানের জন্মভূমি বাজিতখিলা ইউনিয়ন জুড়েই রাতভর শত শত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতয়েন ছিল।
স্থানীয়রা জানায়, রাত তিনটার দিকে হ্যান্ড মাইকে আওয়াজ আসে যারা জানাযার জন্য এসেছেন তারা সসম্মানে চলে যান। জনতা যেতে না চাইলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চার্জ শুরু করে। তখন অনেকেই দৌড়ে পাশেই ধানের চাতালে অবস্থান নেন। ইত্যবসরে রাত সোয়া চারটার দিকে শহীদ কামারুজ্জামানের কফিন এসে পৌঁছায় এতিমখানা চত্বরে।
নিকটাত্মীয় ও কিছু গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নামাযে জানাযার পর ৫টা ৪০ মিনিটে উপস্থিত হাজার হাজার জনতার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বাধা দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মাঠের পূর্ব অংশের অর্ধেক লোক জানাযায় শরীক হতে পারেনি। মাঝখানে ব্যারিকেড দেয়াছিল। এ সময় জনতা নারায়ে তাকবীর শ্লোগানে আকাশ বাতাশ মুখরিত করে তোলে।
এলাকাবাসী যা বলেন:বাজিতখিলা ইউনিয়নের মধ্যকুমরী গ্রামের মজিবর রহমান (৪০) ও আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তারা নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুমতি না দেয়ায় জানাযায় অংশ নিতে পারেননি।
বাজিতখিলা গ্রামের কামরুল ইসলাম বলেন, কামারুজ্জামানের নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য কয়েক হাজার মানুষ এতিমখানার আশপাশে সমবেত হয়েছিলেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের জানাযাস্থলে আসতে দেয়নি।
কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানার পরিচালক নূরুল আমিন বলেন, জানাযায় কেবল শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়।
কামারুজ্জামানের বড় ভাই আলমাছ আলী (৬৮) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ভাই কামারুজ্জামান ছিলেন নিরপরাধ ও নির্দোষ। বিচারের নামে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য যারা দায়ী আল্লাহর কাছে তাদের বিচার চাই।
কামারুজ্জামানের আরেক বড় ভাই মো. কফিল উদ্দিন বলেন, তার (কামারুজ্জামানের) ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানার পাশে দাফন করা হয়।
গায়েবানা জানাযায় জনতার ঢল: শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের জন্য জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশে বিদেশে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ, ময়দান, বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে এ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাযার পূর্বে মুসল্লিদের উদ্দেশে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রেদওয়ান উল্লাহ শাহেদী বলেন, শহীদ কামারুজ্জামানের প্রতি ফোঁটা রক্ত এদেশের মাটিকে ইসলামী আন্দোলনের জন্য উর্বর করবে। তার হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িতদের জনগণের কাঠগড়ায় একদিন দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াত কর্মীরা মহান আল্লাহ ব্যতীত কখনো কারো কাছে মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না ইনশাআল্লাহ। হত্যাকা-, গুম, মামলা ও গ্রেফতার চালিয়ে শহীদী কাফেলার কাজ কেউ বন্ধ করতে পারবে না। সত্যের নিকট মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। মিথ্যা সব সময়ই পরাভূত এবং পরাজিত।
জাতীয় মসজিদে গায়েবানা জানাযা: বাদ যোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রেদওয়ানউল্লাহ শাহেদী, ঢাকা মহানগরী মজলিসে শূরা সদস্য ও মতিঝিল থানা আমীর কামাল হোসেনসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী ও মুসল্লি এতে উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ কামারুজ্জামানের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরবের জেদ্দা, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গায়েবানা নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাযা ও গায়েবানা জানাযায় বাধা : সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বিবৃতিতে বলেন, সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ফাঁসির দন্ড কার্যকরের নামে মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানকে হত্যা করেছে। এ জালিম সরকার শহীদ কামারুজ্জামানের নামাযে জানাযায়ও মুসল্লীদের অংশগ্রহণে বাধা দিয়েছে। শহীদ কামারুজ্জামানের নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য হাজার হাজার জনতা ছুটে আসলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেরিকেড দিয়ে নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুসল্লীদের ওপর গুলী চালানোর ঘোষণা দেয়। অংশগ্রহণকারী মুসল্লীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। যে কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযায় অংশগ্রহণ ধর্মীয় অধিকার। এ অধিকারে বাধা দিয়ে সরকার তার ইসলাম বিরোধী চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করেছে।
তিনি বলেন, সরকার শেরপুর, খুলনা, বরিশাল ও ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ কামারুজ্জামানের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত গায়েবানা নামাযে জানাযা থেকে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে ধর্ম বিরোধী চরিত্রের জঘন্য নজির স্থাপন করেছে। ফেনী জেলার দাগন ভূঁইয়া উপজেলার একটি মসজিদে গায়েবানা নামাযে জানাযার সময় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মসজিদে হামলা চালিয়ে প্রায় ২৫ জন মুসল্লীকে আহত করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুসল্লীদের ওপর বেপরোয়াভাবে হামলা চালায় এবং ৩৫ জনকে গ্রেফতার করে। সরকারের বাধা-বিঘ্ন ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সারা দেশে হাজার হাজার মুসল্লী শহীদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা নামাযে জানাযায় অংশগ্রহণ করে। তার নিজ এলাকায় ফজরের নামাযের পর থেকে অসংখ্যবার হাজার হাজার জনতা পৃথক পৃথকভাবে গায়েবানা নামাযে জানাযার আয়োজন করে এবং অংশগ্রহণ করে। মুসল্লীদের কান্না ও হাহাকারে তার এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জীবন্ত কামারুজ্জামানের চাইতে শহীদ কামারুজ্জামান অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও শহীদ কামারুজ্জামানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে ইনশাআল্লাহ।
জান্নাতের সুবাস ভরা বাজিতখিলায় প্রতিদিন নামে মানুষের ঢল: শহীদ শেরআলী গাজীর এই শতকের উত্তরসূরী শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ঘুমিয়ে আছেন শেরপুরের কুমরী বাজিতখিলায় তাঁর নিজের গড়া এতিমখানার পাশের মাটির বিছানায়। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে গত ১১ এপ্রিল রাত ১০ টা ৩০ মিনিটে ফাঁসির মঞ্চে হাসি মুখে শাহাদাতের মুত্যৃকে বরণ করেছেন ইসলামী আন্দোলনের এই বীর সেনানী। মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর শহীদকে দাফনের জন্য কঠোর নিরাপত্তা তৈরি করে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকা থেকে শেরপুরের পথে রওনা দিলে গাড়ির বহরের সাথে মিডিয়া কর্মীরাও সামিল হয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে শেরপুরের প্রবেশ পথেই আটকে দিয়েছিলো। সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে প্রিয়নেতাকে শেষবিদায় জানাতে পারেননি লাখো লাখো ভক্ত। ভক্তি-শ্রদ্ধা আর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে শহীদের নামাজে জানাজায় শরীক হতে শেরপুরের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রাম এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ হাজির হয়েছিলেন শেরপুরে। কিন্তু তাদের আবেগকে গুলি, লাঠি আর জেল-জুলুমের রাষ্ট্রীয়ত্রাসের পদতলে পিষে ফেলা হয়েছে। তাদেরকে জানাজা নামাজের আশে-পাশে ভিড়তে দেয়া হয়নি। নিরীহ জনগণ পুলিশ বেষ্টনীর বাইরে রাতের আঁধারে যে যেখানে পারেন অবস্থান নিয়ে দূর থেকে শহীদের রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করেন। সকালের সূর্যালোক দেখা দেয়ার সাথে সাথে পিপিলিকার মতো দলে দলে চারদিক থেকে ছুটে আসে বাঁধ ভাঙা মানুষ। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে বাজিতখিলার আকাশ-বাতাস। পরদিন বিবিসিসহ দেশ-বিদেশের অনেক মিডিয়ায় এ খবর প্রচারিত হয়।
কবর যিয়ারতে মানুষের ঢল: নিজ হাতে গড়া শেরপুরের কুমরী বাজিতখিলা এতিমখানার পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। দাফনের পর থেকেই প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ কবর যিয়াতের জন্য। আশেপাশের অনেকেই সময় পেলেই ছুটে আসেন প্রিয় মানুষটির কবর দেখার জন্য। বিশেষ করে জুমার দিনে মানুষের লাইন বেশ দীর্ঘ। কবর যিয়ারত করতে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কামারুজ্জামানের ভক্তরা। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছে না, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এমন একজন মানুষকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো। ঝোলানে হলো ফাঁসির কাষ্টে।
ওই দিন কী হয়েছিল? : ওই দিনে এলাকার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে শহীদ কামারুজ্জামানের ভাই কফিল উদ্দিন বলেন, বিকেলে কারাগারে আমার ভাইয়ের সাথে শেষবারের মতো দেখা করি। সেখান থেকে বের হয়েই আমি একজনকে সাথে নিয়ে সরাসরি বাড়িতে চলে আসি। এসেই দেখি পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে আইন শৃংখলা বাহিনী। এতিমখানার সামনের রাস্তায় মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। তিনি জানান, এখন প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসে। তবে শুক্রবার বেশি আসে। জুমার নামাযের পর সবাই মিলে দোয়া করি।
কামারুজ্জামানের হাতে গড়া বাজিতখিলা এতিমখানার ছাত্র ছিলেন আলমগীর হোসেন। ওখান থেকেই ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন তিনি। পরে আনন্দমোহন কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন। তিনি বলেন, আইন শৃংখলা বাহিনীর কঠোর বেস্টনীর কারণে আশেপাশে হাজার হাজার মানুষ থাকলেও তারা লাশ দেখার জন্য আসতে পারেনি। মাদরাসার সামনের সড়কে যান ও মানুষ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, বাবাকে হারানোর পর তার (কামারুজ্জামানের) উৎসাহেই পড়াশুনা করেছি। সামনে এগুতে পারলাম। আমি আমার প্রিয় অভিভাবককে হারিয়ে ফেললাম।
আবদুল হামিদ (ইমাম সাহেব) বলেন, আমি ও আরেকজন লাশ কবরে নামাই। আমি খুশি, আমি শহীদের লাশ কবরে নামাতে পেরেছিলাম। কাফনের কাপড় রক্তে রঞ্জিত ছিল। মুখ দেখার জন্য টেনে খুলি। ওরা দেখতে দিতে চাচ্ছিল না। আমার পাঞ্জাবীতেও রক্ত লেগেছিল। তাজা রক্তের গন্ধ ছিল। এতিমখানার দেয়ালে এখনও সেই রক্তের দাগ রয়ে গেছে। তিনি বলেন, কফিন আনার পর থেকে দ্রুত দাফন করতে বাধ্য করা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তাগিদে ২০ মিনিটের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। ফজরের পর মোনাজাত হয়। সেকি দৃশ্য! কান্নার রোল। আবেগ আপ্লুত মানুষের আহাজারী। সেটা বলে বুঝানো যাবে না।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ৯ দিনের ছোট একই গ্রামের আবদুস সালাম। তিনি জানান, তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন, বাংলাদেশে তার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোটকাল থেকে তাকে দেখেছি। তার দোষ একটাই তিনি ইসলামের জন্য কাজ করতেন। তিনি বলেন, আমি জানাযা পড়ার জন্য এসেছিলাম। কাছে আসতে দিলো না। ওরা বললো, কাছে আসলে গুলী করবে। একজন তো শার্ট খুলে দিয়েছিল গুলী করার জন্য। ও বললো, নেতা মরে গেছে আমরাও মরবো। কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, বয়স হয়েছে। সময় পেলেই এখানে ছুটে আসি। বসে থাকি।
কুমড়ি-মুদিপাড়ায় কামারুজ্জামানের বাড়িতে : শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন ভাইদের মধ্যে ৪র্থ। তার বড় ভাই আমজাদ আলী (৭০) এরপর আলমাছ আলী (৬৮), এরপর কফিল উদ্দিন (৬৫), এরপর ছিলেন শহীদ কামারুজ্জামান এবং সর্বশেষ নাজিরুজ্জামান (৬০)।
শহীদ কামারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি কুমড়ির মুদিপাড়ায়। সেখানে নেই কোনো ইটের বাড়ি। আছে দোচালা কয়েকটি ঘর। তারই একটিতে গ্রামে আসলে থাকতেন শহীদ কামারুজ্জামান। তার দ্বিতীয় ভাই আলমাছ আলী ঘরটি দেখিয়ে বলেন, এই ঘরে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমাতে পছন্দ করতো জামান। বাড়িতে আসলে সবার খোঁজ-খবর নিতো। সেই ঘরটিতেই এখন শয্যাশায়ী বড় ভাই আমজাদ আলী। দীর্ঘদিন যাবত তিনি অসুস্থ্য। কথাও বলতে পারেন না। সাংবাদিকদের দেখে হাত নেড়ে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, তা বুঝা না গেলেও চোখের পানি দেখে বুঝতে বাকী নেই, ছোট ভাই কামারুজ্জামানকে নিয়ে তার হৃদয়ের কথাই বলতে চেয়েছিলেন।
সেখানে কথা হয় কামারুজ্জামানের ভাতিজা আমজাদ আলীর ছেলে হাবিল উদ্দিন (২৮) এর সাথে। তিনি বলেন, চাচা আমাকে অনেক আদর করতেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তাকে কেনোদিন রাগ করতে দেখিনি। তিনি সব সময় আমার পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিতেন। আমাকে গাইড লাইন দিতেন।
মানুষের ঢল : পাশের উপজেলা নকলা থেকে এসেছিলেন সোহরাব আলী (৬৫)। তিনি বলেন, আমি জামায়াতে ইসলামী করি না। কামারুজ্জামানের বক্তব্য আমার ভালো লাগতো। নামাযে জানাযায় অংশ নিতে না পেরে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ওই দিনও আমি এসেছিলাম। কিন্তু আমাকে কাছে আসতে দেয়া হয়নি। সময় পেলেই আমি কবর যিয়ারতের জন্য ছুটে আসি। বিশেষ করে প্রতি জুমার দিন এখানে নামায পড়ে কবর যিয়ারত করে বাড়ি যাই। তিনি বলেন, তাকে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। তার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ করা হয়, তা কখনই সত্য হতে পারে না। কোনো অন্যায় কাজের সাথে তিনি জড়িত হতে পারে আমি তা বিশ্বাস করি না।
শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসেছিলেন শহীদের কবর যিয়ারত করার জন্য। জুমার নামাযের পর কবরের পাশে আনুষ্ঠানিকভাবে দোয়া করা হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহীদ কামারুজ্জামানের ভক্তরা।
খোলা হয়েছে শোক বই। শোক বইতে শেরপুর শহরের সিদ্দিক উল্লাহ লিখেন, “শহীদ কামারুজ্জামান ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শ্রেণীর শহীদদের কাতারে শামিল হলেন। তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবেই হবে।” সোহাগপুরের শাকিল মাহমুদ লিখেন, “কামারুজ্জামান ভাই এর শহীদী মৃত্যু আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, কাফের, মুশরিক এর কাছে মাথা নতো করা যাবে না। আল্লাহ তাকে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন, আমিন।” ১২ বছর বয়সী নাজিফা আঞ্জুম রানী লিখে, “শহীদ কামারুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাতকে যেন আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন, আমিন।” মোছা: নাজমুন নাহার নাজু লিখেন, শহীদ কামারুজ্জামান ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে বাংলার জমিনে আল্লাহ’র আইন যেন প্রতিষ্ঠিত হয়।”
কেমন আছেন সাক্ষীরা: কামারুজ্জামানের কবর জিয়ারত করতে সোহাগপুর থেকে এসেছিলেন জনৈক মাহমুদ। তিনি জানান, যাদের মিথ্যা সাক্ষীতে কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়েছে, তারা কেউ ভালো নেই। মিথ্যে আতঙ্ক সবসময় তাদেরকে তাড়া করছে। হাছেনা বানু বৃদ্ধ বয়সেও অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেনও অন্যের বাড়িতে। তিনি একা একা পথ চলতে গেলে বা একা ঘরে ঘুমাতে গেলে মনের অজান্তে চিৎকার করে ওঠেন। সব সময় আতঙ্কে থাকেন। একটি মিথ্যে ভয় সব সময় থাকে তাড়া করে। তার সবসময় মনে হয় কে যেন তাকে মারতে তেড়ে আসছে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাত নম্বর সাক্ষী ছিলেন জালাল উদ্দিন। তিনিও শেরপুর জেলার আলোচিত বিধবাপল্লী সোহাগপুরের বাসিন্দা। জালাল উদ্দিন সম্পর্কে স্থানীয় একজন সাংবাদিক জানান, জালাল তাকে বলেছেন, ‘জীবিকা অর্জনের জন্য মাঠে কাজ করতে যাব, সেটাতেও ভয়। আবার খাবার কিনতে বাজারে যাব, সেখানেও শঙ্কা থাকে- ওরা সুযোগ পেলেই হামলা করবে। এখন আমাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।’ এমন অজানা ভয় সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরছে। প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলে ঐ সাংবাদিক বলেন, ‘কেউ তাদেরকে হুমকি দেয় না, বিরক্তও করে না, জামান সাহেবের সমর্থকরা বিচার আল্লাহর কাছে দিয়ে রেখেছে। হয় তো বিবেকের দংশনে অথবা মিথ্যে আতঙ্কে তারা আতঙ্কিত।
কবর জিয়ারত করতে আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অন্যতম সাক্ষী মোহন মুন্সী। মোহন মুন্সি ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা ও শ্বাসকষ্টসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সব সময় মরণকে আহবান করছে। সে মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলে,‘আল্লাহ আমাকে নেয় না কেন?’ মোহন মুন্সীর শরীরে পচন ধরেছে। মোহন মুন্সির আপন ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে আজিজুর রহমান রন্জু নামের জনৈক ব্যক্তি বলেন, তার কাছ কিছুদিন আগে সে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়ে পা পিছলে কাঁচা পায়খানায় পড়ে গিয়েছিলো। তার প্রায় গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলো। সমস্ত শরীরে ইনফেকশন হয়েছে সেখান থেকে পচাঁ পূজ বের হচ্ছে। দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া: মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচারের রায় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় আরেক নেতাকে ফাঁসি দিতে যাচ্ছে বলে আখ্যায়িত করেছে। অনেক মিডিয়ায় এই ইসলামিক স্কলারের হত্যার ষড়যন্ত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বলে প্রতিবেদন ছেপেছে। বিশ্ববিখ্যাত সংবাদ সংস্থা বিবিসির হেডলাইনটি হলো ‘ইসলামিস্ট লিডার কামারুজ্জামানস এপিল রিজেকটেড’। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার অনলাইনেও গতকাল পরিবেশিত খবরে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে একজন ইসলামিস্ট লিডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলজাজিরা পরিবেশিত খবরে কামারুজ্জামানকে জামায়াত নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি’র,অনলাইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টও এ বিচার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় ঘোষণার সাথে সাথেই বিশ্বের বিভিন্ন টিভি, অনলাইন পোর্টাল এবং সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে বিশেষ গুরুত্বের সাথে খবরটি পরিবেশন করা হয়।
তুরস্কের দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ: জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা আনাডোলু এজেন্সি এ খবর দিয়েছে। এতে বলা হয়, তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত শনিবার এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয়া হয়।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল তুরস্ক। একই সঙ্গে সামাজিক সম্প্রীতি ও দেশে শান্তি ধরে রাখার জন্য একই রকম অন্য মৃত্যুদ-গুলো স্থগিত রাখারও আহ্বান জানিয়েছে। মৃত্যুদ- বাতিল করা হয়েছে এমন একটি দেশ হিসেবে এই শাস্তি কার্যকর করায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে তুরস্ক। ফাঁসি কার্যকর করায় সমাজে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বাতিল করে তুরস্ক। এর পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ-ের শাস্তি বর্ধিত করে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচার করতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০১৩ সালের মে মাসে শাস্তি হিসেবে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- দেয়। নভেম্বরে তার একটি আপিল খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি কার্যকর হওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি কামারুজ্জামান। এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর আরেক নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাকের মূল্যায়ন: যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দুনিয়াতে নতুন কিছু নয়। আজ থেকে ৭০ বছর আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সর্বপ্রথম নুরেমবার্গ ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। তার পরে টোকিও, সাবেক যুগোস্লøাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়ন, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লেবাননসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে। এসব বিষয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন সামরিক বিভাগের লোক। এর বাইরে যারা ছিলেন তারা ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী। স্মরণ করা যেতে পারে, যে সময়ে কামারুজ্জামান ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ১৮-১৯। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল তা হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্ব ছিল। এটা যুগপৎভাবে অবিশ্বাস্য ও নজিরবিহীন। শহীদ কামারুজ্জামান ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে প্রতিহিংসাবাদীরা হয়তো বিজয়ের হাসি হেসেছেন, কিন্তু তারা জানেন না দ্বীন-দুনিয়ার মালিক কী অভিভাষণে তাকে পরকালে স্বাগত জানাবেন। আল কুরআনের ভাষায়- ‘তাকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলল, হায় ! আমার জাতি যদি কোনোক্রমে জানতে পারতো কিভাবে আমার পরোয়ারদিগার আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।’ (৩৬ : ২৬-২৭)
রাজনীতি একটি কঠিন ও জটিল বিষয়। রাজনীতিবিদদের দূরদর্শী হতে হয়। কামারুজ্জামান ভাইয়ের রাজনীতি বিশ্লেষণী ক্ষমতা যে কতটা পরিপক্ব ছিল এবং তিনি যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে কারাগার থেকে ২০১০ সালে প্রকাশ করা এক ভাবনায়। ফাঁসির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের জীবন রক্ষার উদ্বেগের পরিবর্তে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়েই ছিলেন উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক সমস্যার অত্যন্ত গভীরে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন এবং এর সমাধানের জন্য জাতীয় রাজনীতিতে হানাহানি বন্ধ করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির প্রস্তাবনা রেখেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে, শুধু এভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। তিনি ১১টি পয়েন্টের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ অবস্থা বিশ্লেষণ করে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মাত্র চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি যে এতটা দূরদর্শী ছিলেন তার জীবদ্দশায় এ সত্যটা অনুধাবন করতে পারিনি বলে আজ খুবই আক্ষেপ করছি।
শহীদ কামারুজ্জামান চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে দশটায় দুনিয়াবাসী তাকে চিরবিদায় জানিয়েছে অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে। এখন তিনি আছেন আসমানবাসীর তত্ত্বাবধানে। আল কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা : ‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে কখনো মৃত মনে কোরো না; বরং তারা তাদের পালনকর্তার কাছে জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।’(৩ : ১৬৯)
আজ এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, কামারুজ্জামান ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার ধানমন্ডির বাসভবনে তাকে আর কোনো দিন অভ্যর্থনা জানাতে পারব না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার নয়া পল্টন ল-চেম্বারসে তিনি আর কোনো দিন সাক্ষাৎ করতে আসবেন না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, টেলিফোনে তার কণ্ঠস্বর আর কোনো দিন শুনতে পারব না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তার হাসিমাখা মুখ এই দুনিয়ায় আর কোনো দিন দেখতে পাবো না। কামারুজ্জামান ভাই ছিলেন বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। ইসলামি আন্দোলনের আকাশে আরেকজন কামারুজ্জামানের আবির্ভাব কবে ঘটবে দূর প্রবাসে বসে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় (অঁঃঁসহ ড়ভ ষরভব) তাই ভাবছি আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আরজি জানাচ্ছি তিনি যেন ভাই কামারুজ্জামানের শাহাদত কবুল করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দেন এবং ইসলামি আন্দোলনে তার অভাব পূরণ করে দেন।
বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এক ক্ষণজন্মা নেতা; বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নের জন্য অপরিহার্য সততা,মেধা-যোগ্যতা,অভিজ্ঞতা,ক্লিন ইমেজ-জনপ্রিয়তায় সমৃদ্ব অনন্য প্রতিভা। স্বাধীন-আত্বনির্র্ভশীল বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধী সা¤্রাজ্যবাদী চক্রের তাই তিনি চক্ষুশূল।
সাংবাদিক,লেখক,বুদ্বিজীবি,সংগঠক,রাজনীতিবীদ পরিচয়ের বাইরেও শেরপুর জেলার বাজিতপুর গ্রামে ১৯৫২ সলের ৪ জুলাই জন্ম নেয়া মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এ মাটির সন্তান।জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নীতিনির্ধারক হলেও পিতা-মাতার আদরের দুলাল,সন্তানদের পিতা,মিসেস নুরুন্নাহারের স্বামী।আর দশ জন নাগরিকের মত ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার তাঁর রয়েছে-বেঁচে থাকার অধিকারতো বটেই।
হাজার বছরের বিরল ব্যক্তিত্ব আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যারা নারী ধর্ষক,খুনী,ডাকাত ঘোষনা করতে পারে;কসাই কাদের সাজিয়ে অসাধারন প্রতিভাধর রাজনীতিবীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাসী দিতে পারে তাদের কাছে কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। শুধু দেখার বিষয়-কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি বিবেকের যে তীব্র ঘৃনাবৃষ্টি এরা নিজেদের জন্য অপরিহার্য্য করে নিয়েছে তার ফিরিস্তি আর কত দীর্ঘতর করবে? যারা অনুভ’তিকে তালাবদ্ব করে প্রকারান্তে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন তাদের নিরবতা কবে ভাংগবে অথবা পরিণতি কি ঘটতে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নের অভিযাত্রার গতিপথের কি হয় ?
শেষ কথা: যে কথিত অভিযোগে কামারুজ্জামানকে আজ কারাগারে আটক রাখা হয়েছে সে অভিযোগের কোন রকম সত্যতা নেই। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামী ও আদর্শিক চেতনার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন। তিনি একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ। রাজনৈতিক ময়দানে তাঁর অবদান দেশের ইসলাম বিরোধী শক্তির সহ্য হচ্ছে না। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধাপরাধের কথিত অভিযোগ।
এমন প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ আজ হত্যার গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। মানব সমাজে আজ মনে হচ্ছে সত্য পন্থীরাই যেন অপরাধী। প্রকৃত অপরাধীরা যেন সাধু!!! জালেমের বিষাক্ত হুংকার মানব সমাজকে কাঁপিয়ে তুলছে। খোদাদ্রোহী দুনিয়া আজ অত্যাচার, নিপীড়ন, প্রতারণা, হঠকারিতা ও দুর্র্ধষতা ও অপরাজনীতির সীমানা ছেড়ে গেছে। নির্যাতিতের করুণ ফরিয়াদে আকাশ বাতাস দলিত মথিত ও তিক্ত-বিষাক্ত। কিন্তুু তারপরও কি সত্য পথের সৈনিকেরা কি ভিত? না, বরং প্রতিটি মুমিন এই বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দেয়াকে নিজের ঈমানী দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেই এগিয়ে চলছে। এই রকম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে সকল নবী রাসুল (স:) কে। যুগে-যুগে যারাই সেই পদাংক অনুসরণ করবে, তাদের প্রত্যেককেই একই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এটাই স্বাভাবিক।
আজ আমাদের প্রিয় নেতা জনাব কামারুজ্জামান ভাই সেই পরীক্ষায় অবতীর্ণ। কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সা.) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’ আল্লাহর দ্বীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন আমেরিকা, ইউরোপ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, পাকিস্তান সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড় কি সেই আলোকচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির দুনিয়ার কোন শক্তির কাছে নতি শিকার করতে পারে?