মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে ঢের সময় লেগে যায়। প্রকৃত আদর্শবান মানুষের পরিচয় এই ঘূর্ণায়মান মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশ বিরল। এই প্র্রকৃত আদর্শবান মানুষেরা তাদের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন, হয়ে যান মানব সভ্যতার ইতিহাসের অমোচনীয় অংশ। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা প্রকৃতপক্ষে মানব সত্ত্বাবান অসংখ্য মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত এই রকম একজন রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, একটি নাম, একটি বিস্ময়কর প্রতিভা, একটি ইতিহাস, একজন কিংবদন্তী।
এই মহান মানুষটি ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের জরিপের ডাঙ্গী গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দাদা: আবু মোল্লা, বাবা: সানাউল্লাহ মোল্লা, মা: বাহেরুন্নেসা বেগম, নয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। তার জন্মের কিছুকাল পরে তার পিতা-মাতা সদরপুরেরই আমিরাবাদ গ্রামে এসে বাড়ি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।
কে জানতো সময়ের ব্যবধানে এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন আব্দুল কাদের মোল্লা। কে জানতো এই আব্দুল কাদের মোল্লা হবেন বিপণ্ণ মানবতার মুক্তির কাণ্ডারী, তিনি হবেন অন্ধকার পৃথিবীতে এক উজ্জ্বল নীল নক্ষত্র, কে জানতো নিজ মাতৃভূমির শাসক কর্তৃক নির্মম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে তিনি হবেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। কে জানতো তাঁর আদর্শ থেকে উদগিরিত লাভা ধ্বংস করে দেবে মিথ্যাবাদীদের ক্ষমতার রাজপ্রাসাদ!
শৈশব এবং যৌবন
শিশুকাল থেকে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসেবে গ্রামে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রাথমিক বৃত্তি এবং ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৬৮ সালে একই বিদ্যাপীঠ থেকে বিএসসি পাশ করেন। এসময় যৌবনের প্রথম ধাপে তাঁর চরিত্র-মাধুর্য সহপাঠীদের আকৃষ্ট করে। সমবয়সী হওয়ার পরও অনেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে আপনি বলে সম্বোধন করতো। তার নির্মোহ জীবন সম্পর্কে আঁচ করা গিয়েছিলো অতি শৈশবকালীন আচরণ থেকে।
প্রবল আর্থিক সংকট এবং কর্মজীবনের সুত্রপাত
জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা আর্থিক সংকট মোকাবেলা করে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যান। বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করে প্রবল আর্থিক সংকটের মুখে পড়েন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। চরম অর্থ সংকট তাঁকে থামিয়ে দিতে উদ্যত হলেও তিনি বাধা ভেঙ্গে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয়ে সদরপুরেরই বাইশরশি শিব সুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। একজন আদর্শ, জ্ঞানী, চরিত্রবান শিক্ষক হিসাবে তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
উচ্চ শিক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফরিদপুর, ১৯৭১ এবং
অসাধারণ মেধার অধিকারী আব্দুল কাদের মোল্লা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। তখন গণঅভ্যুত্থানের সংগ্রামী চেতনা মানুষের প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা হল ও পরে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা তাঁর আকর্ষণীয় চরিত্র দিয়ে আকৃষ্ট করলেন শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের, হয়ে উঠলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়মুখ। ১৯৭১ সাল। উত্তাল হয়ে উঠলো সমগ্র বাংলা, আব্দুল কাদের মোল্লা বসে থাকলেন না। ৭মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের পর থেকে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে তিনি বন্ধুদের সাথে প্রায় বসতেন, এমন পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কীভাবে তাদের মুক্তির পথ উন্মুক্ত করবে তার উপায় খোঁজার চেষ্টা করতেন তারা । তিনি বুঝতে পারলেন বাঙালির এই পথ কণ্টকাকীর্ণ, মুক্তির জন্য ঝরাতে হবে রক্ত, দিতে হবে তাজা তাজা প্রাণ। ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গণহত্যার কয়েকদিন আগেই শিক্ষক ডঃ ইন্নাস আলীর নির্দেশে তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে পারলেন না।
৭ মার্চের পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবার বাড়ি ফিরে যাবেন, সংগঠিত করবেন এলাকার যুবক বন্ধুদের, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য তিনি যুদ্ধ করবেন। ফরিদপুরের বাড়ি ফিরে এলেন। প্রতি রাতে বের হতেন সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। ইতোমধ্যে এলাকার যুবকেরা সংগঠিত হয়ে গেছে। শহীদ আব্দুল কাদের যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জেসিও মফিজুর রহমান এসকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের ট্রেনিং শুরু করলেন। পহেলা মে পাক-হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করলো। পহেলা মে হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে ঢুকলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সঙ্গীগণ আর প্রকাশ্যে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পারলেন না। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় না আসা পর্যন্ত ফরিদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গোপনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
১৯৭২ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত দেশে আরো অনেকের মতো শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শিক্ষাজীবনের ছেদ ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই ই আর (ইন্সিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৭৭ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনে মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন ।
পুনরায় কর্মজীবন
১৯৭৫ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৭৮ সালে ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এ রিসার্চ স্কলার হিসেবে যোগ দেন।
সাংবাদিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা
এটা আশির দশকের কথা। দেশ তখন সামরিক জান্তা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদের কবলে। সামরিক জান্তা সরকার জনগণের কণ্ঠ রোধ করে ফেলেছে প্রায়। জাতির আকাশে তখন দেশী শকুন ডানা ঝাপটিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দিশাহীন বাঙালি জাতি আবার যেন ঘোর সংকটে নিমজ্জিত হলো। সামনে এগিয়ে এলেন শহীদ আব্দুল কাদেরের মতো সাহসী লোকরা। শিক্ষকতা পেশায় যে সত্যের পরশ তিনি পেয়েছিলেন, তা সাধারন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি সাংবাদিকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন। সত্য প্রকাশে একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের পাতায় পাতায় ।
১৯৮১ সালে সাব-এডিটর পদে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় যোগ দেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর দক্ষতা এবং দূরদর্শীতার কারণে পত্রিকাটির প্রথমে সহকারী সম্পাদক ও পরে কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে সকল পত্রিকা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছিলো ‘দৈনিক সংগ্রাম’ তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ‘বীক্ষণ’ ও ‘সহজ বচন’ ছদ্মনামে কলাম লিখতেন। তার লেখা আর্টিকেলগুলো সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ, রসালো লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, সোনার বাংলা, পালাবদল, মাসিক পৃথিবী, কলম ইত্যাদি নানা দৈনিক, মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকাটি আরো আকর্ষনীয় করে পাঠকপ্রিয় করে তুলেন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভের পাশাপাশি ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দু’বার তিনি ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিক্ষক আব্দুল কাদের মোল্লা একজন আপোষহীন সাংবাদিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অন্তরে দ্রোহ আর বিপ্লবের চেতনা লালন করেও সদা হাস্যেজ্জ্বল এ মানুষটি ছিলেন সাংবাদিক আড্ডার প্রাণ-ভ্রমরা। তার রসময় গল্পকথার সজীবতায় ভরে উঠতো গনমানুষের চেতনার প্রতীক জাতীয় প্রেসক্লাব। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারনে এক সময় সাংবাদিকতার পেশাকে বিদায় জানাতে হয় তাকে। কিন্তু যে পেশা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এর মহত্বকে তিনি ধারণ করতেন সবসময়। তাইতো তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের প্রতিটি ধুলিকণা এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে কাদের মোল্লার স্মৃতি।
কিন্তু একজন আদর্শবাদী সাংবাদিকের জীবন সাধারণভাবেই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। কখনো সমাজের বিপথগামী অংশ, কখনো কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল, আবার কখনও বা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির রোষানলে পড়তে হয় তাকে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন সংঘর্ষে উৎসর্গিত হয় সাংবাদিকের জীবন। চারপাশের চেনাজন, পরিচিত বন্ধুমহল একসময়ে পরিণত হয় তার শত্রুতে। হানে প্রাণঘাতি ছোবল। যে ছোবলের রূপ হয় নানারকম। মানসিক যন্ত্রণায় বিপন্নতা, শারিরিক আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ, প্রাণঘাতি হামলায় মৃত্যু, কারাবন্দিত্বের নিঃসঙ্গ যাতনা কিংবা প্রহসনের বিচারে জীবনাবসান। এসবই ছিল যুগে যুগে সাংবাদিক জীবনের অনিবার্য উপাদান। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
রাজনৈতিক জীবন
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা একজন দেশ ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। এই দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণই সব সময় তার ধ্যানজ্ঞান ছিল। একজন সচেতন ব্যক্তি হিসাবে তাই কৈশোরে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা তৎকালীন সমাজের অন্যান্য মানুষের মত সমাজতন্ত্রের চটকদার রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মাওলানা মওদূদী (রহঃ) এর তাফসীর ‘তাফহীমুল কোরআন’ পড়ে কোরআনের হৃদয়স্পর্শী বাণীতে মুগ্ধ হন এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে ছাত্রসংঘে যোগদান করেন। তিনি পরবর্তীতে ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালে মে মাসে তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রুকন হন এবং একই সাথে ইসলাম বিরোধী মহলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেন। তিনি ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এবং ঢাকা মহানগরীর শূরা সদস্য এবং কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্পদিনের ব্যবধানেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশ-এ-শূরার সদস্য হন। ১৯৮৩ সালে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমীর, ১৯৮৭ সালে ভারপ্রাপ্ত আমীর, ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে ঢাকা মহানগরীর আমীর এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমীর হিসাবে নতুন যুগের সুচনা করেন। তিনি খোলামেলা স্বভাবের হওয়ার ফলে যেকোনো সাধারন কর্মী উনার কাছে পৌঁছে যেতে পারতো ও সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পেত। তিনি নানা যুক্তি দিয়ে যেকোনো মানুষকে বুঝাতে পারতেন, দাওয়াত দিলে তিনি সব জায়গায় যেতেন। নিরাপত্তার কোন কারণ তাকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। শৃঙ্খলার নামে অতিরিক্ত কড়াকড়ি তার পছন্দ ছিল না।
লিয়াঁজো কমিটি ও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা
সাংবাদিক নেতা হওয়ার কারনে সব ধরনের রাজনৈতিক মহলে উনার অবাধ যাতায়াত ছিল। মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে মিশে যাওয়ার কারনে জামায়াত তাকে বিভিন্ন দলের সাথে লিয়াঁজো করার দায়িত্ব দেয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম উনার বিভিন্ন দলের সাথে লিয়াঁজো করার দক্ষতা প্রকাশ পায়। যদিও তখন এটা ছিল অনানুষ্ঠানিক ও গোপন। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে কেন্দ্রীয় লিঁয়াজো কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াত আনুষ্ঠানিক ভাবে লিয়াঁজো কমিটি করে বিভিন্ন দলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে দিনের পর দিন তিনি মিটিং করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতেন ও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। তখন কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এবং তা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন শহীদ আবদুল কাদেও মোল্লা। ১৯৯৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি ও তোফায়েল একসাথে আত্মগোপনে ছিলেন। জেলে তিনি ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা বাসার খাবার ভাগাভাগি করে খেতেন।
আওয়ামী লীগ শাসন আমলে ১৯৯৯ সাল থেকে জামায়াত-বিএনপি লিয়াঁজো শুরু হয়। চারদলীয় লিয়াঁজো কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। লিয়াঁজো কমিটিতে বিভিন্ন সময়ে নানা দায়িত্ব পালন করার কারনে বিএনপি দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ উভয় দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আন্দোলনের নীতি নির্ধারণী সভাতে মিলিত হতেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ দলের সাথে লিয়াঁজো করার কারনে ও রসাত্মক ব্যক্তি হওয়ার কারণে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে উনার সখ্যতা হয়। রাজনৈতিক নেতাগণ তাদের একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানেও উনাকে দাওয়াত করতেন।
জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা
তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রচার সম্পাদক হওয়ার পরে তিনি জামায়াতের প্রচার বিভাগের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। তার সময়েই প্রচার বিভাগের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়, লোকবল বাড়ানো হয়, প্রচার বিভাগকে আধুনিকীকরন করার জন্য কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টার সহ অন্যান্য জিনিস কেনা হয়। জামায়াতের নিজস্ব ইংরেজি বুলেটিন আরবীতে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ বাড়ানো ও নিয়মিত করা হয়। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ২০০৪ সালের মার্চ মাসে স্বল্প সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের বাইরে সারা বিশ্বে মুসলমানদের উপরে অত্যাচার ও নির্যাতনের ব্যাপারে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, লেবানন, ইরাক ইত্যাদি নানা জায়গায় যখনই মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখনই শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, মিছিল করেছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য তিনি আর্থিক সাহায্যও জোগাড় করে পাঠিয়েছেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে তিনি নানা দেশের হাইকমিশন-এমব্যাসিতে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন ও জামায়াতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।
কারাবরণ
১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ অভিযোগে এবং বামপন্থিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৭১ সালে স্থানীয় কিছু লোকের ভুল বোঝাবুঝির কারনে তাকে থানায় আটকে রাখা হয়। স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লুতফুল করীম তাকে সাথে সাথেই ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন ।
স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রীয় ভূমিকা রাখায় ১৯৮৫ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে জামায়াতের অন্যান্য নেতা সহ গ্রেফতার হন। প্রায় চারমাস আটক থাকার পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে ১৪ই অগাস্ট তিনি মুক্তি পান।
১৯৯৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সাথে একই দিনে তিনি গ্রেফতার হন। সাত দিন পরে তিনি মুক্ত হন।
কূটনৈতিক অঙ্গনে কাদের মোল্লা
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার কূটনীতিকদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জল ও রসিক কাদের মোল্লার কথা ছাড়া কোন প্রোগ্রাম জমজমাট হতো না। জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নানা কূটনীতিক প্রোগ্রামে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি জামায়াতের সব ধরনের কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তার দূরদর্শী, জ্ঞান ও তথ্যসমৃদ্ধ কথা কূটনীতিকদের বিমোহিত করত। অনর্গল ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারার দক্ষতা থাকায় কাদের মোল্লার সাথে কূটনীতিকদের সাথে অতি দ্রুত ভাব হয়ে যেত। সমসাময়িক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপরে তার ভাল দখল থাকায় কূটনীতিকদের সাথে তিনি সাচ্ছন্দে কথা বলতে পারতেন। কূটনীতিকদের সাথে মিশে যাওয়ার একটা প্রবনতা তার মাঝে লক্ষ্য করা যেত। ফলে কূটনীতিকরা তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও উনাকে দাওয়াত করতেন।
বিদেশ ভ্রমন
জনাব মোল্লা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, সংযুক্তআরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, নেপাল, মালায়েশিয়া সহ নানা দেশ সফর করেছেন। তিনি ইসলামিক মিশন অফ জাপানের আমন্ত্রনে ১৯৯৭ সালে জাপান যান। তিনি ইসলামিক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকার আমন্ত্রনে ২০০০ সালে আমেরিকা ও কানাডা যান। সেখানে তিনি নানা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন তিনি। কানাডার বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যান তিনি। ২০০২ সালে তিনি ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপ এর দাওয়াতে যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ভ্রমন করেন। তিনি বেশ কয়েকবার ওমরাহ্ ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রাজকীয় অতিথি হিসাবে সৌদি আরব যান।
বিবাহ
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শ্বশুর দিনাজপুর নিবাসী মীর নাতেক আলী একাধারে কলকাতা রাইটারস বিল্ডিং, ইডেন বিল্ডিং, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, সেটেলমেন্ট অফিসার, সার্কেল রেভিনিউ অফিসার, টিএনও ইত্যাদি সরকারী পদ অলঙ্কার করে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসাবে কর্মজীবন শেষ করে অবসর নেন। তিনি বই এবং পত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত আব্দুল কাদের মোল্লার লেখা “মেরাজ একটি বৈজ্ঞানিক সত্য” শিরোনামের আর্টিকেল মীর নাতেক আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। ঘটনাক্রমে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে বিয়ে দিতে বিনাবাক্যে রাজি হন। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর জনাব মীর নাতেক আলীর কন্যা বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার দুই ছেলে এবং চার মেয়ে।
বেগম সানোয়ার জাহান এবং মুক্তিযুদ্ধ
বেগম সানোয়ার জাহান ইডেন কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনিও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মত বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ও ইডেন কলেজের ছাত্রী ইউনিয়নের জিএস ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম সানোয়ার জাহান তাঁর পিতার সাথে কুষ্টিয়াতে ছিলেন। বেগম সানোয়ার জাহানের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বেগম সানোয়ার জাহান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক মতো খাবার পেতো না। এমন সময় বেগম সানোয়ার জাহান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়মিত খাবার পাঠাতেন। এভাবে সাধ্যমতো মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের, নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে ওঠে।
পারিবারিক জীবন
রাসুল (সঃ) এর আদর্শ অনুসরনে সদা সচেষ্ট ছিলেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। ইসলামের যাবতীয় বিধি-নিষেধ তিনি যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করতেন। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) যেমন শুধু রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না, শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে একজন যথার্থ স্বামী ছিলেন। অনুরূপ, রাসুলের (সঃ) আদর্শে অনুপ্রাণিত আব্দুল কাদের মোল্লা পারিবারিক সকল কাজ করতেন। শত ব্যস্ততার মাঝে বাজার করতেন, স্ত্রীর রান্নার কাজে সহযোগিতা করতেন, ঘর পরিস্কার ও গুছাতেন। একজন স্বামী হিসেবে তিনি স্ত্রীর কাজের মর্যাদা দিতেন এবং সহযোগিতা করতেন।
উনি নিয়মিত শুক্রবারে পারিবারিক বৈঠক করতেন। কুরআন-হাদিস সম্পর্কে আলোচনা করতেন। উনি বাচ্চাদেরকে মাথায় নিয়ে ঘুরতেন। বড় মেয়ের দুই ছেলে উনার বিশেষ পছন্দের ছিল। গ্রেফতার হওয়ার আগে উনি প্রায়ই ডেকে এনে এদের সাথে সময় কাটাতেন। গান শোনাতেন। উনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন ও নানা সমস্যার সমাধান দিতেন। সাংগঠনিক সফরে সময় থাকলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতেন। আত্মীয় স্বজনের সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। দরিদ্র আত্মীয়দের সাহায্য করতেন। সাংবাদিকতা ও রাজনীতি নিয়ে সদাব্যস্ত এ মানুষটি যখন পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হতেন, তখন মনেই হতো না শত বোঝা কাঁধে নিয়ে তিনি হাঁটছেন অনন্তের পথে। পরিবারের ছোট সদস্যদের সংস্পর্শে এলে তিনি যেন হয়ে যেতেন শিশুর মতই কোমল। এসব গুনাবলীর কারণে নিতান্ত অপরিচিতজনও নিমিষেই হয়ে যেতো তার বন্ধু। তবুও দ্বীন কায়েমের কঠোর তাগিদে পারিবারিক বন্ধনকে অনেক সময়ই দিতে হয়েছে অনিচ্ছাকৃত ছুটি।
একান্ত জীবন
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার অন্যতম অভ্যাস ছিল নিজের কাজ একান্ত ভাবে নিজের মনে করা। নখ কাঁটা, জামা-লুঙ্গি ছিঁড়ে গেলে সেলাই করা, নিজের মোজা-গেঞ্জি-টুপি ধোয়া, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি পরিস্কার করা, দাড়ি ছাটাই করা ইত্যাদি নানা কাজ করার সময় তিনি আপন ভুবনে ডুবে যেতেন। মাছ ধরা তার প্রিয় শখ ছিল। নানা জায়গায় তিনি মাছ ধরতে যেতেন। অবসর সময়ে মাছ ধরার যন্ত্রপাতি ঠিক করতেন। তিনি ডায়াবেটিক রোগী ছিলেন। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করতেন।
বই পড়া ছিলো তার নিয়মিত অভ্যাস। শত-সহস্র ব্যস্ততার মাঝে তিনি শুধুই পড়তেন। জ্ঞানপিপাসু এই মানুষটি জ্ঞানার্জনে ছিলেন অবিচল, শ্রান্তিহীন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বই কিনতেন, নিজের লাইব্রেরী ছিল তার সেই সদরপুরের জীবন থেকেই। ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি শুধু ইসলামি বই-পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তা নয়, বরং তিনি সকল কোরআন, হাদিস, ইসলামি সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম, মতাদর্শ, দর্শন, বিজ্ঞানের বই পড়তেন। শিশু-কিশোরদের বইও পড়তেন। ভাল কোন বই পড়লে সেকথা অন্যকে বলতেন ও বই দিতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সময়ে গাড়িতে উনি বই পড়তেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপরে ইংরেজিতে লেখা বই উনি নিয়মিত সময় করে পড়তেন। আন্তর্জাতিক নানা পত্র-পত্রিকার আর্টিকেল প্রিন্ট করে রাতে শোওয়ার সময় পড়তেন।
শিক্ষাবিদ
জনাব মোল্লা সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে বাদশাহ ফয়সাল ইন্সটিটিউট, ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি ও এর স্কুল অন্যতম। তিনি পর পর তিন বার বাদশাহ ফয়সাল ট্রাস্টের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকার অন্যতম নামকরা বিদ্যাপীঠ গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। একজন ইসলামী শিক্ষাবিদ হিসাবে আধুনিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার সেতুবন্ধনে তিনি সারা জীবন কাজ করেছেন। আধুনিক শিক্ষার উপরে তার নানা বিশ্লেষণধর্মী আর্টিকেলগুলো সবসময় প্রশংসিত হয়েছে। শিক্ষার উপরে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। তার প্রবন্ধ সব সময়েই মৌলিকত্বের দাবি রাখতো। শিক্ষানুরাগী মানুষ মাত্রই কাদের মোল্লার কথায় অন্য মাত্রা খুঁজে পেতেন। জামায়াত-শিবির আয়োজিত শিক্ষা দিবস উপলক্ষে নানা সেমিনারে উনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। কুদরতে খুদা সহ অন্যান্য শিক্ষা কমিশন সম্পর্কে উনার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা মানুষের চিন্তার খোরাক ছিল। মানারাতের পাঠ্যক্রম ও সিলেবাস প্রনয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি প্রকাশিত নানা বইতে তিনি সম্পাদনা করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের শিক্ষা বিপ্লবে ব্যাপারে তিনি সব সময় চিন্তা করতেন। প্রত্যাশিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তার আর্টিকেলগুলো ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই তার ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। তার সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। অনেক লেখকরা উনার কাছে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের জন্য দিত।
সামাজিক কর্মকাণ্ড
জনাব মোল্লা সক্রিয় ভাবে সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী, সদরপুর মাদরাসা ও এতিমখানা, ফরিদপুর জেলার হাজিডাঙ্গি খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা ও এতিমখানা, সদরপুর আল-আমিন একাডেমী ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া ফরিদপুরের নানা অঞ্চলে মসজিদ তিনি করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের নানা এলাকার ও ফরিদপুরের অসংখ্য দরিদ্র মানুষের তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ধনী লোক-জনের কাছ থেকে টাকা এনে এলাকার লোকদের সাহায্য করেছেন। বন্যার সময়ে ফরিদপুর, রাজবাড়ি ইত্যাদি নানা এলাকায় নৌকা করে মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য নিয়ে গিয়েছেন, ওষুধ বিলি করেছেন, স্যালাইন দিয়েছেন, বিশুদ্ধ পানির ট্যাবলেট দিয়েছেন। গরিব শিক্ষাথীদের মাঝে বই-খাতা বিলি করেছেন। এতিম-মিসকিন দের মাঝে জামা কাপড় দিয়েছেন। জাকাতের টাকা এনে দিয়েছেন। তিনি বাড়ি গেলে গরিব দরিদ্র মানুষের লাইন লেগে যেত। সবাইকে তিনি সাধ্য মত সাহায্য করেছেন। গরিব মেয়েদের বিয়ে দিতে তিনি সাহায্য করেছেন। নলকূপ করে দিয়েছেন, ব্রিজ- কালভার্ট করেছেন।
ঈদের সময় তিনি প্রায় গ্রামের বাড়ি যেতেন। মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতেন। ঈদের নামাজের মাঠে যাওয়ার আগে সামান্য মিষ্টি খেতেন। ঈদের নামাজের আগে সবার প্রতি কথা বলতেন, ঈদের মাসলা-মাসায়েল জানাতেন, ছেলেদেরকে নিয়ে নামাজে প্রথম কাতারে দাঁড়াতেন। কখন কখন তিনি নিজেই নামাজ পড়াতেন, খুতবা দিতেন। নামাজ শেষ করে সাধারন মানুষের সাথে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কোলাকুলি করতেন। নামাজ শেষ করে যে পথে নামাজের জন্য এসেছেন, অন্য পথে বাড়ি ফিরতেন। কোরবানি ঈদের সময় নামাজ শেষ করেই পশু কোরবানির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। অনেকের অনুরোধে অনেক মানুষের পশু কোরবানি করে দিতেন। রক্তে তার পাঞ্জাবি ভিজে যেত। জবাইকৃত পশুর গোস্ত দিয়ে নাশতা করতেন। অনেক মানুষ দেখা করতে আসত। তাদের সাথে দেখা করা, কথা বলা, খোঁজ-খবর নেয়া তার স্বভাব ছিল। অভাবি মানুষকে তিনি এই ঈদের সময় সাহায্য করতেন।
সংস্কৃতি ও খেলাধুলা
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শিক্ষার প্রতি আগ্রহের পাশাপাশি ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে ভাল গান গাইতেন। জামায়াত-শিবিরের রুকন-সদস্যদের শিক্ষাশিবির ও প্রশিক্ষন অনুষ্ঠানে তিনি নানা সময়ে গান গেয়েছেন। ইসলামি আন্দোলনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাথমিক কাজ হিসেবে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীকে এক সময়ে তিনি শক্ত ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম তৈরি করার ব্যাপারে তিনি সব সময় কাজ করেছেন। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আর্থিক ভাবে উনি সাহায্য করতেন। খেলার প্রতিও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিলো। ফুটবল খেলা খুব পছন্দ করতেন। তিনি নিজে এক সময় ভাল ফুটবল খেলতেন। শাররীক চর্চার জন্য উনার কাছে খেলাধুলা প্রয়োজনীয়তা ছিল। এছাড়া মাঝে মাঝে উনি ক্রিকেট খেলা দেখতেন। পরিবারের ছেলেদেরকে খেলাধুলা করতে উৎসাহিত করতেন। উপমহাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তী জাদুকর সামাদের গল্প করতেন মাঝে মাঝে। দলীয় অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের শারীরিক সুস্থতার জন্য খেলার পরামর্শ দিতেন।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার ও বিচার
জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার জীবন সব সময়ই প্রকাশ্য এবং স্বচ্ছ। তিনি কোন গোপন আন্দোলনের সদস্য কিংবা কোন গোপন ব্যক্তি ছিলেন না। দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কেউ কখনও তাকে যুদ্ধপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেননি অথবা “কসাই কাদের মোল্লা” বলেও ডাকেনি। বিগত ৪০ বছরের তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি অভিযোগও কোথাও উত্থাপিত হয়নি। যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকার, আলবদর, আলশামস হিসাবে কোন তালিকায় তার নামতো দূরের কথা, সন্দেহভাজনের তালিকায়ও নাম ছিল না। এমনকি এধরনের অপরাধে তাকে কেউ ইতঃপূর্বে অভিযুক্তও করেনি।
স্বাধীনতার প্রায় ৪ দশক পর ২০০৭ সালে ওয়ান ইলাভেনের অদ্ভূত সরকারের সময়ে হঠাৎ করেই যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। শুরু হয় ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের পরিকল্পিত চরিত্রহনণ। আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে যে সব জামায়াত নেতাগণ সাহসী ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে চলে অব্যাহত মিথ্যা প্রচারণা। যে আওয়ামী লীগ নেতারা এক সময়ে যে জামায়াত নেতাদের সাথে একই টেবিলে বসে চা খেতে খেতে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছেন, সেই আওয়ামী নেতারা ঐ সব জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসিত বক্তব্য দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদের দিয়ে জামায়াত নেতাদের নামে নানা মামলা দায়ের করতে থাকে। ঐ বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন শীর্ষ জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ১৩ জুলাই ২০১০। সকাল ১১টা। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান হাইকোর্টে আসেন জামিনের জন্য। মামলার যখন শুনানী চলে তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রধান গেটের সামনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক গোয়েন্দা সদস্য এবং শাহবাগ থানার পুলিশসহ অগনিত পুলিশ। আব্দুল কাদের মোল্লা এবং মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান সুপ্রিমকোর্ট চত্বর পার হয়ে প্রধান ফটকে গেলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। মানবতার কল্যাণের জন্য যে মানুষটি সদা তৎপর ছিলেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত অবিরাম ছুটেছেন, সে নির্মল চরিত্রের অধিকারী মানুষটির উপর ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগ আনা হলো !
২৬ জুলাই ২০১০ তারিখে আব্দুল কাদের মোল্লাকে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ হাজির করা হয়। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না থাকলেও আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করে ট্রাইব্যুনাল। ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কসাই কাদের উল্লেখ করে সাতটি চার্জ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ২৮ মে ২০১২ তারিখে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ উল্লেখ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২। ৩জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামী পক্ষে ছয় জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর শুরু হয় তথাকথিত শাহবাগ আন্দোলন। ‘অভিনব’ এই আন্দোলনের ফলে ২০১৩ সালের ১৭ ফেরুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে সরকার ও পরবর্তীতে তার সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে রাস্ট্রপক্ষ।
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানির জন্য। ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।
আব্দুল কাদের মোল্লার শাহাদাত বরণ
সরকারের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ১১ ডিসেম্বর বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামীপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে ১১ ডিসেম্বর শুনানি শেষে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
১২ ডিসেম্বর সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড। ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু কার্যকর করা হয়। মৃত্যু কার্যকর করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে এই মহান শহীদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার জন্মস্থান সবুজ ছাওয়া ঘেরা ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়া পুলিশী প্রহরায় ইসলামী আন্দোলনের এই নেতাকে তার পিতা-মাতার পাশে দাফন করা হয়। ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা চলে গেলেন সুবাসিত জোছনার দেশে !
শুরু হলো এক নতুন ইতিহাস, নির্বাক হয়ে দেখলো পৃথিবী ! মিথ্যার রোষানলে সত্যকে উজ্জীবিত রাখতে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে সত্যের জয়গান গাইলেন তিনি! একজন আদর্শ মুসলিমের পরিচয় দিলেন বিশ্বজনীন এই প্রাণবন্ত মানুষটি। একজন মুসলমান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নোয়াবার নয়! ওরা চিরদিন দমিয়ে রাখতে চেয়েছে আল কোরানের বাণী, কিন্তু যুগে যুগে জন্ম নিয়েছে শহীদ কুতুব, শহীদ হাসান আল বান্না আর শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মতো সাহসী প্রাণ। যাঁরা জীবনবাজি রেখে নির্ভীক চিত্তে লড়েছেন। আপাতঃ মূল্যবান ইহ জাগতিক প্রাপ্তিকে যাঁরা তুচ্ছজ্ঞান করে চিরস্থায়ী চিরশান্তির নহর ধারা প্রবাহিত, ফুলে-ফলে সুশোভিত জান্নাতের পথে সদা-সর্বদা থেকেছেন অবিচল, তাঁরা কোরআনের পতাকা, আদর্শ এবং বিধানকে পৃথিবীর বুকে সমুন্নত রেখেছেন।
বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করা এ রায় শুধুমাত্র কাদের মোল্লার দেহ থেকে প্রাণের বন্ধনকেই আলাদা করতে পেরেছে, পারেনি শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার লালিত আদর্শের অগ্রযাত্রায় প্রতিরোধের বাঁধ দিতে। যার জীবনের শেষ দিনগুলো ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসকে করেছে আরও মহিমান্বিত। যা অনাগত প্রজন্মের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করবে কেয়ামত পর্যন্ত। তার শেষ জীবনের কথাগুলো স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মানসপটে। আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন এক অলৌকিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট, যে জীবন ছিলো রাসুল (সাঃ) প্রদর্শিত, যে জীবন ছিলো আবুবকর, ওমর, আলী, ওসমানদের, খোদাভীরুদের। সে জীবন সত্যি আলোয় আলোয় ভরালেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্যের পথের যাত্রীরা পেলো ক্লান্তিহীন অবিচল চলার শক্তি, মজবুত ঈমান, নিশ্চল আদর্শ, সীমাহীন সাহস। অন্তরে এলো মহাপরাক্রমশালীর পক্ষ থেকে বিশ্বাস; সত্যের বিজয় একদিন আসবেই। রাতের আঁধারের অপতৎপরতাগুলো রাতের আঁধারেই মিলিয়ে যাবে, রাত শেষে উদিত হবে সত্যের সূর্য। যে সূর্য নিয়ে আসবে আলো, আলো আসবেই। আর শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা চিরদিন বেঁচে থাকবেন এদেশের লক্ষ কোটি মানুষের অন্তরে। একদিন তার রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই ইনশাআল্লাহ্।