আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানব-সত্তায় বহুবিধ চাহিদা জুড়ে দিয়েছেন। আবার, এই আল্লাহই মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই সৃষ্টি করেছেন। তদুপরি আল্লাহ মানুষকে তার চাহিদা পূরণে সম্পদ আহরণ, সম্পদ রূপান্তরিতকরণ এবং সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা দান করেছেন। এই জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মানুষ আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে। মানুষের কোন কোন চাহিদা আপনা-আপনিই পূরণ হয়। কোন কোন চাহিদা মানুষ একক প্রচেষ্টায় পূরণ করতে পারে। কোন কোন চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্যই পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, আর্থিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র-সংগঠন গড়ে ওঠে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই বায়ু। পৃথিবীর চারদিকে একটি পুরো বায়ুমণ্ডল জুড়ে দিয়ে আল্লাহ মানুষের এই চাহিদা পূরণ করেছেন।এই চাহিদা আপনা-আপনি পূরণ হয়। শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে বায়ু অটোমেটিক মানুষের ফুসফুসে যাতায়াত করে। বায়ুর চাহিদা মেটাবার জন্য মানুষকে কষ্ট করতে হয় না। চেষ্টা চালাতে হয় না। শীতের দিনে শীত তাড়াবার জন্য তাপের প্রয়োজন। তাপ লাভের অন্যতম উপায় রোদ পোহানো। কেউ শীত তাড়াতে চাইলে রোদে গিয়ে দাঁড়ালে শীত দূর হয়। এইভাবে তাপ লাভের জন্য তাকে কারো সহযোগিতা নিতে হয় না। অর্থাৎ সে একাই তার এ চাহিদা পূরণ করতে পারে।
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য চাই। আল্লাহ শস্য, ফল, শাক-সবজি, তরি-তরকারি ইত্যাদি উৎপন্ন করার উপযুক্ত করে মাটি সৃষ্টি করেছেন। এই মাটি কর্ষণ করে, এতে বীজ বপন করে এবং চারাগাছ পরিচর্যা করে এইগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হয়। আবার, চুলোর উপর পাতিলে সেদ্ধ করে এইগুলো খাওয়ার উপযোগি করতে হয়। খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং খাদ্য প্রস্তুতকরণের বিভিন্ন স্তরে একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয় এবং আল্লাহ পৃথিবীময় যেইসব উপাদান মওজুদ করে রেখেছেন সেইগুলোর রূপান্তর ঘটিয়ে অপরাপর মানুষ যেইসব উপকরণ তৈরি করেছে, সেইগুলোর সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ সে একা এ চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
মানুষের চাহিদার তালিকা বেশ দীর্ঘ। মানুষের খাদ্য চাই, পানি চাই, ঘর চাই, পোশাক চাই, ঔষধ চাই, শিক্ষা চাই, ভাব প্রকাশের সুযোগ চাই, বাহন চাই, নিরাপত্তা চাই, যুল্মের প্রতিকার চাই। ইত্যাদি। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো বা চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের জীবনকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য, মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য এবং মানুষের জীবনকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহ যেইসব নিয়ামাতের ব্যবস্থা করেছেন সেইগুলো সবই মানুষের রিয্ক।উল্লেখ্য যে অন্যান্য সৃষ্টির রিয্কের ব্যবস্থাও আল্লাহই করে থাকেন। রিয্ক তালাশের নির্দেশ
এই পৃথিবীর অংগনে মুমিনদেরকে দুইটি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হয়। একটি হালাল জীবিকা উপার্জনের সংগ্রাম, অপরটি আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম। জীবিকা উপার্জনে উদাসীন হওয়া, সংসার ত্যাগী হওয়া, বৈরাগী হওয়া, সন্ন্যাসী হওয়া এবং আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম বিমুখ হওয়া ইসলাম নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা নয়। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لاَرَهْباَنِيَّةَ فىِ الْاِسْلاَمِ[মুসনাদে আহমাদ]
“ইসলামে রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ নেই।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَرَهْبَانِيَّةَ نِ ابْتَدَعُوْهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ[সূরা আল হাদীদ : ২৭]
“আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে, আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি।”
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِيْنَةَ اللهِِِ الَّتِىْ أَخْرَجَ لِعِبَادِه وَالْطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِىَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَّوْمَ الْقِيَامَةِ[সূরা আল আ‘রাফ : ৩২]
“তাদেরকে বলে দাও ঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেইসব সাজ-শোভা এবং পবিত্র রিয্ক দান করেছেন, সেইগুলোকে হারাম করলো কে? দুনিয়ার জীবনে এইগুলো তো মুমিনদের জন্যই এবং আখিরাতেও একান্তভাবে তাদের জন্যই হবে।” অর্থাৎ আল্লাহর অনুগত বান্দা হওয়ায় মুমিনরাই এইগুলো ভোগ-ব্যবহারের প্রকৃত হকদার।
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِى الأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ [সূরা আল আ‘রাফ ঃ ১০]
“আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এতে তোমাদের জন্য জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছি। তোমরা সামান্যই শুকরিয়া আদায় করে থাকো।”
هُوَ الَّذِىْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِى الْأَرْضِ جَمِيْعاً[সূরা আল বাকারা : ২৯]
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।”
وَآتَاكُمْ مِّنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللهِ لاَ تُحْصُوْهَا[সূরা ইবরাহীম : ৩৪]
“এবং তোমরা যা চাও (অর্থাৎ তোমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন) সবই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামাত গুলো গণনা করতে চাও তা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
هُوَ الَّذِىْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوْا فِىْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِه وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ[সূরা আল মুলক : ১৫]
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর বুকে বিচরণ কর এবং আল্লাহর দেওয়া রিয্ক (আহরণ করে) খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তাঁর দিকেই যেতে হবে।”
ياَ أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِذَا نُوْدِىَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَّومِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ. فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল জুমু‘আ : ৯, ১০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, জুমু‘আর দিন যখন ছালাতের জন্য ডাকা হয় আল্লাহর স্মরণে দৌড়ে আস, বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জান। ছালাত আদায় করে যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাক। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اُطْلُبُوا الرِّزْقَ فِىْ خَباَ ياَ الْاَرْضِ [আয়িশা (রা), মুসনাদু আবী ইয়া‘লা]
“তোমরা মাটির গভীর তলদেশে রিয্ক তালাশ কর।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا[সূরা আল বাকারা : ২৭৫]
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।”
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ[সূরা আল বাকারা : ১৯৮]
“(হাজের সময়ে) তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ কর এতে কোন দোষ নেই।”
…وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ …[সূরা বানী ইসরাঈল : ১২]
“এবং আমি দিনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ করতে পার।”
وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا [সূরা আন নাবা : ১১]
“এবং আমি দিনকে জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছি।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,ماَ اَكَلَ اَحَدٌ طَعاَماً قَطُّ خَيْرًا مِّنْ اَنْ يَّاْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ.[মিকদাম ইবনু মা‘দী কারাব (রা), সহীহ আল বুখারী]
“কারো জন্য নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার আর নেই।”আল্লাহর রাসূলকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “কোন্ উপার্জন উত্তম?”
তিনি বললেন,عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِه وَكُلُّ بَيْعٍ مَّبْرُوْرٍ.
“ব্যক্তির নিজের হাতের উপার্জন এবং সৎ ব্যবসা।”
[রাফে‘ ইবনু খাদীজ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,اِذَا صَلَّيْتُمُ الْفَجْرَ فَلاَ تَنُوْمُوْا عَنْ طَلْبِ اَرْزَاقِكُمْ.
[আনাস ইবনু মালিক (রা), আলকাউলুল মুসাদ্দাদ]
“তোমরা ছালাতুল ফাজর আদায়ের পর তোমদের রিয্ক তালাশে নিয়োজিত না হয়ে ঘুমিয়ে থেকো না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,طَلَبُ كَسْبِ الْحَلاَلِ فَرِيْضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ.
[আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রা), সুনানু আল বাইহাকী]
“নির্ধারিত ফারযগুলোর পর হালাল জীবিকা তালাশ করাও ফারয।”
আল্লাহই রিয্ক দিয়ে থাকেন
“সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত যতো প্রকারের যতো মাখলুক আল্লাহ সৃষ্টি করবেন তাদের প্রত্যেকের সঠিক চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের সব সরঞ্জাম হিসাব করে তিনি পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন। স্থলভাগে ও পানিতে অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে। যাদের প্রতিটি শ্রেণীর খাদ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন অন্য সব শ্রেণী থেকে ভিন্ন। আল্লাহ বায়ুমণ্ডল স্থল ও পানিতে অসংখ্য প্রজাতির জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি প্রজাতির স্বতন্ত্র ধরণের খাদ্য প্রয়োজন। তাছাড়া এইসব প্রজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের সৃষ্টি মানুষ। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন শুধু দেহের লালন ও পরিপুষ্টি সাধনের জন্যই নয়, তার রুচির পরিতৃপ্তির জন্যও নানা রকম খাদ্যের প্রয়োজন। আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে কি জানা সম্ভব ছিলো, মাটির তৈরি এই গ্রহটির ওপর জীবনের উৎপত্তি থেকে শুরু করে তার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কোন্ কোন্ শ্রেণীর সৃষ্টিকুল কত সংখ্যক, কোথায় কোথায় এবং কোন্ কোন্ সময় অস্তিত্ব লাভ করবে এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য কোন্ প্রকারের খাদ্য কত পরিমাণ দরকার হবে? নিজের সৃষ্টি পরিকল্পনানুসারে যেইভাবে তিনি খাদ্যের মুখাপেক্ষী এইসব মাখলুককে সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, অনুরূপভাবে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য সরবরাহেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদুদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা হামীমুস সাজদার তাফসীরের ১২ নাম্বার টীকা।]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন, وَكَأَيِّنْ مِّنْ دَابَّةٍ لَّا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ [সূরা আল আনকাবূত : ৬০]
“অসংখ্য জীব এমন রয়েছে যারা নিজেদের রিয্কের ভাণ্ডার বহন করে বেড়ায় না। আল্লাহই তাদেরকে রিয্ক দেন এবং তোমাদের রিয্কও তিনিই দেন।”
وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِى اْلأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ [সূরা হূদ : ৬]
“পৃথিবীতে এমন কোন জীব নেই যার রিয্কের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়। তিনিই জানেন কার বাস কোথায় এবং তাকে কোথায় রাখা হয়। সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।”
إِنَّ اللهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِيْنُ [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫৮]“নিশ্চয়ই আল্লাহই রিয্কদাতা, অটল ক্ষমতার অধিকারী।”
وَاْلأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيْهَا رَوَاسِيَ وَأَنْبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ شَىْءٍ مَّوْزُوْنٍ. وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَّسْتُمْ لَه بِرَازِقِيْنَ .وَإِنْ مِّنْ شَىْءٍ إِلاَّ عِنْدَنَا خَزَائِنُه وَمَا نُنَزِّلُه إِلاَّ بِقَدَرٍ مَّعْلُوْمٍ [সূরা আল হিজর : ১৯-২১]
“আমি পৃথিবীকে ছড়িয়ে দিয়েছি। এর ওপর পাহাড় গেড়ে দিয়েছি। এর মধ্যে পরিমাণ মত নানা ধরণের গাছ-পালা জন্মিয়েছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের রিয্কদাতা তোমরা নও। এমন কোন জিনিস নেই যার ভাণ্ডার তাঁর হাতে নয়। এবং আমি তা সুনির্দিষ্ট পরিমাণে নাযিল করে থাকি।”
وَجَعَلَ فِيْهَا رَوَاسِىَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيْهَا وَقَدَّرَ فِيْهَا أَقْوَاتَهَا فِىْ أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءَ لِّلسَّائِلِيْنَ [সূরা হামীমুস সাজদা : ১০]
“তিনি (পৃথিবীকে অস্তিত্বদানের পর) ওপর থেকে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন। এতে বারাকাত দান করেছেন। আর এতে সকল প্রার্থীর চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে রিয্ক নির্দিষ্ট করেছেন, মাত্র চারদিনে।”
قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَىْءٍ قَدْرًا [সূরা আত্ তালাক : ৩]
“আল্লাহ সবকিছুরই একটি পরিমাণ ঠিক করে রেখেছেন।”
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ
[সূরা আয্ যুখরুফ : ৩২]
“আমি দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবনোপকরণ বণ্টন করেছি, এদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোককে অন্যদের ওপর বেশি মর্যাদা দিয়েছি যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পারে। এরা যা জমা করে তার চেয়ে তোমার রবের রাহমাত অনেক বেশি মূল্যবান।”
اللهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِه يَرْزُقُ مَنْ يَّشَاءُ وَهُوَ الْقَوِىُّ العَزِيْزُ [সূরা আশ্ শূরা : ১৯]
“আল্লাহ সূক্ষ্ম বদান্যতাপ্রবণ। যাকে ইচ্ছা রিয্ক দেন। তিনি শক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী।”
قُلْ إِنَّ رَبِّىْ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِه وَيَقْدِرُ لَهُ وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِّنْ شَىْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُه وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ [সূরা সাবা : ৩৯]
“তাদেরকে বলে দাও ঃ আমার রব তাঁর বান্দাদের যাকে ইচ্ছা প্রচুর রিয্ক দেন, আর যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন। আর তোমরা যা খরচ কর তার পরিবর্তে তিনি তোমাদেরকে আরো রিয্ক দেবেন। তিনিই তো সর্বোত্তম রিয্কদাতা।”
لَه مَقَالِيْدُ السَّموتِ وَالْأَرْضِ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيْمٌ [সূরা আশ্ শূরা : ১২]
“আসমান ও যমীনের চাবি তাঁরই হাতে। তিনি যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান কম দেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর জ্ঞান রাখেন।”
أَوَلَمْ يَعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّ فِىْ ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ [সূরা আয্ যুমার : ৫২]
“তারা কি জানে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা ঈমান পোষণ করে।”
قُلْ إِنَّ رَبِّىْ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ
[সূরা সাবা : ৩৬]
“তাদেরকে বলে দাও : নিশ্চয়ই আমার রব যাকে চান প্রশস্ত রিয্ক দেন এবং যাকে চান সংকীর্ণ রিয্ক দেন। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই এর তাৎপর্য জানেনা।”
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيْرًا [সূরা বানী ইরাঈল : ৩১]
“এবং তোমরা অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকে রিয্ক দেবো, তোমাদেরকেও দিচ্ছি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মস্ত বড় গুনাহ।”
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُمْ مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
[সূরা আল আন‘আম : ১৫১]
“এবং অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। তোমাদেরকে রিয্ক দিচ্ছি, তাদেরকেও দেবো,।”
وَلَوْ بَسَطَ اللهُ الرِّزْقَ لِعِبَادِه لَبَغَوْا فِى الْأَرْضِ وَلكِنْ يُّنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا يَشَاءُ
[সূরা আশ্ শূরা : ২৭]
“আল্লাহ যদি তাঁর বান্দাদেরকে সীমাহীন রিয্ক দান করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি ইচ্ছা মতো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে রিয্ক নাযিল করেন।”
فَابْتَغُوْا عِنْدَ اللهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوْا لَه
[সূরা আল আনকাবূত : ১৭]
“অতএব আল্লাহর কাছেই রিয্ক অনুসন্ধান কর, তাঁরই ইবাদাত কর এবং তাঁরই শুকরিয়া আদায় কর।”
রিয্কের প্রাচুর্য অথবা সংকীর্ণতা দ্বারা
আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনে যাকে যা কিছু দিয়েছেন তা পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন।
আল্লাহ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, প্রভাব-পতিপত্তি ইত্যাদি পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান, এইগুলো পেয়ে সে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে, না অকৃতজ্ঞ হয়।
আবার আল্লাহ অভাব-অনটন, বিপদ-মুসিবাত ইত্যাদিও পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান অভাব-অনটন ও বিপদ-মুসিবাতে পড়ে মানুষ তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্য ধারণ করে, না নৈতিকতার বাঁধন ছিন্ন করে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
فَأَمَّا الْإِنسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّه فَأَكْرَمَه وَنَعَّمَه فَيَقُوْلُ رَبِّىْ أَكْرَمَنِ .وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُولُ رَبِّىْ أَهَانَنِ [সূরা আলফাজর : ১৫, ১৬]
“কিন্তু মানুষের অবস্থা হচ্ছে ঃ যখন তাঁর রব তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তাকে সম্মান ও নিয়ামাত দান করেন তখন সে বলে ঃ আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আবার তিনি যখন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন, তখন সে বলে ঃ আমার রব আমাকে হেয় করেছেন।”
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কাউকে সুদর্শন এবং কাউকে কুৎসিত রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী এবং কাউকে দুর্বল দেহের অধিকারী রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে মেধাবী এবং কাউকে মেধাহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে স্মৃতিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সুষ্ঠু প্রত্যংগসহ এবং কাউকে বিকলাংগরূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে দৃষ্টিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে কর্তৃত্বশীল এবং কাউকে কর্তৃত্বহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে খ্যাতিমান এবং কাউকে খ্যাতিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
এই সকল অবস্থাই মানুষের জন্য পরীক্ষা। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে সদা সচেতন থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য চেষ্টা করা।
আল্লাহর অনুগত ব্যক্তি ও জাতি
সহজে রিয্ক লাভ করে থাকে
দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতের জীবনে মানুষের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ হয় তার কৃত আমলের নিরিখে। কোন ব্যক্তি যদি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন-যাপন করে আল্লাহ তাকে জীবিকার পেরেশানী দ্বারা পর্যুদস্ত করবেন, এটা স্বাভাবিক নয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهُ مَخْرَجًا .وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
[সূরা আত্ তালাক : ২, ৩]
“যেই ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলে আল্লাহ তাকে কঠিন অবস্থা থেকে নি®কৃতি পাওয়ার পথ দেখান এবং এমন উপায়ে তাকে রিয্ক দেন যে উপায়ের কথা সে কখনো কল্পনাও করেনি।”
[তবে ঈমানী দৃঢ়তা পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন যদি কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তি-সমষ্টিকে অভাব-অনটন অথবা অন্য কোন মুসিবাতে ফেলেন, সেটা ভিন্ন কথা। এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَىْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ اْلأَمَوَالِ وَاْلأنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ [সূরা আল বাকারা : ১৫৫]
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো। আর ছবর অবলম্ব^নকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।”]
وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِىْ فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنِّىَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيْرٍ
[সূরা হূদ : ৩]
“এবং তোমরা যদি তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদেরকে একটি মেয়াদ পর্যন্ত উক্ত জীবিকা দান করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য প্রত্যেককে অনুগ্রহ করবেন। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, আমি তোমাদের জন্য এক ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয় করছি।”
وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلى قُوَّتِكُمْ وَلاَ تَتَوَلَّوْاْ مُجْرِمِيْنَ [সূরা হূদ : ৫২]
“এবং ওহে আমার কাউম, তোমরা তোমাদের রবের নিকট ইস্তিগফার কর, তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদের জন্য আসমানের দুয়ার খুলে দেবেন এবং বর্তমান শক্তির সাথে আরো শক্তি যুক্ত করে দেবেন। তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে থেকো না।”
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ لِأَكَلُوْا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ مِّنْهُمْ أُمَّةٌ مُّقْتَصِدَةٌ وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُوْنَ
[সূরা আল মা-ইদা : ৬৬]
“এবং তারা যদি আত্ তাওরাত, আল ইনজীল এবং তাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে তা কায়েম করতো, তাহলে তারা ওপর থেকেও রিয্ক পেতো, নিচ থেকেও পেতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক অভিপ্রেত পথেই আছে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ লোকই মন্দ কাজ করে চলছে।”
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرى آمَنُواْ وَاتَّقَواْ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَاْلأَرْضِ وَلَـكِنْ كَذَّبُواْ فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُواْ يَكْسِبُوْنَ[সূরা আল আ‘রাফ : ৯৬]
“আর যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বারাকাতের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেই উড়িয়ে দিলো। তাই আমি তাদের কামাই অনুযায়ী তাদেরকে পাকড়াও করলাম।”
পক্ষান্তরে আল্লাহর অবাধ্য ব্যক্তিকে আল্লাহ পেরেশানীযুক্ত জীবিকা দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِىْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُه يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمى
[সূরা তা-হা : ১২৪]
“আর যেই ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে, আমার উপদেশনামা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ (পেরেশানীযুক্ত) জীবিকা। আর কিয়ামাতের দিন আমি তাকে ওঠাবো অন্ধ করে।”
আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম
সাধারণ অর্থে ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত বিধান।
গোটা বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত, প্রাকৃতিক আইন বলে পরিচিত, বিধানগুলো আসলে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান।
বিশেষ অর্থে ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে এই বিধানে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান হওয়ায় ইসলাম নির্ভুল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকর জীবন বিধান।
গোটা বিশ্ব প্রকৃতিতে স্বীয় বিধান কার্যকর করলেও আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মানব সমাজে তাঁর বিধান কার্যকর করেননি। তাঁর অভিপ্রায় মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁর দেওয়া জীবন বিধান কবুল করুক এবং তার ভিত্তিতে তারা সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলে পৃথিবীকে শান্তির নীড়ে পরিণত করুক।
আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান কায়েমের জন্যই মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পালন করার জন্যই মানুষের নিযুক্তি। অর্থাৎ মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে সৃষ্টি করার প্রাক্কালে গোটা বিশ্বের ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
إِنِّىْ جَاعِلٌ فِى اْلأَرْضِ خَلِيْفَةً [সূরা আল বাকারা : ৩০]
“আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।”
আবার মানুষ পৃথিবীতে আসার পর তিনি মানুষকে তার পজিশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
هُوَ الَّذِىْ جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِى الْأَرْضِ [সূরা ফাতির : ৩৯]
“তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন।”
এই পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আর মানুষের জীবন মিশন হচ্ছে ইকামাতুদ্ দীন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصّى بِه نُوحًا وَالَّذِىْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِه إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسى وَعِيْسى أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ
[সূরা আশ্ শূরা : ১৩]
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দীনের সেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা এখন আমি তোমার নিকট ওহীর মাধ্যমে পাঠাচ্ছি এবং যার নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম ইবরাহীমকে, মূসাকে এবং ঈসাকে, (আর তা হচ্ছেঃ) এই দীন কায়েম কর এবং এতে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।”
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে নূহ (আ), ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) এবং ঈসা (আ)-এর প্রতিও দীন কায়েমের নির্দেশ ছিলো।
এই আয়াতে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের কয়েকজন নবীর নাম নেয়া হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে এই কয়জন নবীকে শুধু দীন কায়েমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। আসলে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে সকল নবীরই জীবন মিশন ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
নবীর উম্মাতের জীবন মিশনও ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
এখানে উল্লেখ্য যে দীন অটোমেটিক কায়েম হয় না। আবার জোর-জবরদস্তি করেও দীন কায়েম করা যায় না।
দীন কায়েমের জন্য বিজ্ঞতাপূর্ণ সংগ্রাম প্রয়োজন। নবী-রাসূলগণ দীন কায়েমের পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন একের পর এক বহু সংখ্যক নবী পাঠিয়েছেন মানব সমাজে। তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাঁরা আবির্ভূত হয়েছেন বিভিন্ন কালে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার দীন কায়েমের জন্য তাঁরা সকলেই অবলম্বন করেছেন অভিন্ন কর্ম-কৌশল।
নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর দেওয়া জীবন বিধান অনুসরণের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
যেখানেই মানুষ সেখানেই তাঁরা ছুটে গেছেন। কখনো এক ব্যক্তির কাছে, কখনো ব্যক্তি-সমষ্টির কাছে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয়িত অংশটুকু ছাড়া তাঁদের সময়, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়োজিত হয়েছে এই সুমহান কাজে। তাঁদের প্রতি যাঁরা ঈমান এনেছিলেন তাঁদেরও কর্মধারা ছিলো অনুরূপ।
যদিও সকল মানুষকে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে তাঁর দীন কায়েমের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, নবীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাঁরা তাঁদের কাফিলায় শামিল হয়েছেন তাঁরা ছাড়া বাকিরা আল্লাহদ্রোহিতাকে তাদের জীবন মিশন বানিয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এইভাবে তারা পৃথিবীর জীবনে তো অকল্যাণের শিকারে পরিণত হয়েছেই, যেই কর্তব্য সাধনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিলো তা না করার কারণে আখিরাতে তাদেরকে অবশ্যই হতে হবে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন।
সফল জীবনের পরিচয়
পৃথিবীর বেশি সংখ্যক মানুষকেই জীবনের প্রকৃত মিশনের প্রতি উদাসীন থেকে ‘সফলতার’ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বেহুঁশের মতো ছুটতে দেখা যায়।
এই জীবনে টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে পারাকেই তারা মনে করে সফলতা।
কিন্তু মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের দৃষ্টিতে সফলতার স্বরূপ ভিন্ন। আল কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে তিনি সফল ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরেছেন যাতে মানুষ ‘সফলতার’ ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে, সঠিক ধারণা লাভ করতে এবং সঠিক কর্ম ধারা অবলম্বন করতে পারে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
أَلاَ إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ الَّذِينَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ لَهُمُ الْبُشْرُى فِى الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِى الْاخِرَةِ لاَ تَبْدِيْلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪]
“জেনে রাখ, যারা আল্লাহর বন্ধু, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই। দুনিয়া এবং আখিরাতে- উভয় জীবনেই তাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর কথা পরিবর্তিত হবার নয়। এটি বড়ই সফলতা।”
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّاهَا [সূরা আশ্ শামস : ৯, ১০]
“অবশ্যই সেই ব্যক্তি সফল যে নিজকে পরিশুদ্ধ করে নিয়েছে। আর সেই ব্যক্তি বিফল যে নিজকে দাবিয়ে দিয়েছে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنْصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল মা-য়িদা : ৯০]
“ওহে যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করার স্থান এবং ভাগ্য গণনার জন্য শর নিক্ষেপ নাপাক, শাইতানী কাজ। তোমরা এইগুলো পরিহার করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
فَاتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّه وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِّلَّذِيْنَ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আর রূম : ৩৮]
“আত্মীয়দেরকে তাদের হক দাও, মিসকীন ও মুসাফিরদেরকেও। যারা আল্লাহর সন্তোষ প্রত্যাশী তাদের জন্য এটি খুবই উত্তম কাজ। তারাই ঐসব লোক যারা সফল।”
قُلْ لاَ يَسْتَوِى الْخَبِيْثُ وَالطَّيِّبُ وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيْثِ فَاتَّقُوْا اللهَ يا أُولِى الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল মা-য়িদা : ১০০]
“বলে দাও ঃ অপবিত্রতার আধিক্য তোমাদেরকে চমৎকৃত করলেও পবিত্র ও অপবিত্র জিনিস সমান নয়। ওহে জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَ تَأْكُلُوْا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আলে ইমরান : ১৩০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
فَأَمَّا الَّذِيْنَ امَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ فَيُدْخِلُهُمْ رَبُّهُمْ فِى رَحْمَتِه ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْمُبِيْنُ[সূরা আল জাসীয়া : ৩০]
“অতপর যারা ঈমান এনেছে এবং আমালে ছালেহ করেছে তাদের রব তাদেরকে তাঁর রাহমাতের মধ্যে দাখিল করে নেবেন। এটি সুস্পষ্ট সফলতা।”
الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْناهُمْ يُنْفِقُوْنَ. والَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ أُوْلـئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আল বাকারা : ৩-৫]
“যারা গাইবে বিশ্বাস করে, ছালাত কায়েম করে, আমি যেই রিয্ক তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে দান করে, যারা তোমার প্রতি ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান পোষণ করে, আর আখিরাতের প্রতিও যাদের রয়েছে ইয়াকীন, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে। আর তারাই সফল।”
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُولِه لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আন্ নূর : ৫১]
“নিশ্চয়ই মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা মেনে নেওয়ার জন্য ডাকা হয় তখন তারা বলে ঃ আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। এবং এরাই সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُولَه فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا
[সূরা আল আহযাব : ৭০, ৭১]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল এবং সোজা সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আমলগুলো সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। আর যেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে সে লাভ করেছে বিরাট সফলতা।”
الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ أُوْلئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা লোকমান : ৪, ৫]
“যারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখিরাতের প্রতি ইয়াকীন রাখে, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে। আর তারাই সফল।”
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِىْ شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيلاً [সূরা আন্ নিসা : ৫৯]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর উলুল আমরের (আদেশ প্রদানের অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের)। তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং শেষ ফলের দিক দিয়ে এটাই ভালো।”
فَالَّذِيْنَ امَنُوْا بِه وَعَزَّرُوْهُ وَنَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوْا النُّوْرَ الَّذِىْ أُنْزِلَ مَعَهُ أُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আল আ‘রাফ : ১৫৭]
“অতপর যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সহযোগিতা করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার প্রতি নাযিলকৃত নূরের (আল কুরআনের) অনুসরণ করে, তারাই সফল।”
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَه أُوْلـئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيْمٌ وَعَدَ اللهُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِى جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আত্ তাওবা : ৭১, ৭২]
“এবং মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ শিগ্গিরই তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞ। এই মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত এবং সেখানে তারা থাকবে চিরদিন। সবুজ বাগানে তাদের জন্য উত্তম বাসস্থান থাকবে। আর সবচে’ বড় কথা, তারা আল্লাহর সন্তোষ হাছিল করবে। আর এটাই তো বড় সফলতা।”
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ .الَّذِيْنَ هُمْ فِىْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ .وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ .وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ إِلَّا عَلى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُوْمِيْنَ فَمَنِ ابْتَغى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْعَادُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُوْنَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ أُوْلَئِكَ هُمُ الْوَارِثُوْنَ الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ[সূরা আল মুমিনূন : ১-১১]
“সফলতা লাভ করলো সেই সব মুমিন যারা তাদের ছালাতে খুশু অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকে, যারা পবিত্রতা বিধান কাজে তৎপর থাকে, যারা লজ্জাস্থানের হিফাজাত করে নিজেদের স্ত্রী ও দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীন স্ত্রীলোকদের ছাড়া, এই ক্ষেত্রে তারা ভর্ৎসনাযোগ্য নয়, তবে এর বাইরে কিছু চাইলে তারা হবে সীমালংঘনকারী, যারা আমানাত ও ওয়াদা প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে, যারা ছালাতের পূর্ণ হিফাজাত করে। তারাই সেই উত্তরাধিকারী যারা উত্তরাধিকার হিসাবে ফিরদাউস পাবে, সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল।”
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكى لَهُمْ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلى جُيُوْبِهِنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِيْنَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ ابَائِهِنَّ أَوْ ابَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِىْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِىْ أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِيْنَ غَيْرِ أُوْلِى الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِيْنَ لَمْ يَظْهَرُوْا عَلى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِيْنَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوْبُوْا إِلى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
[সূরা আন্ নূর : ৩০, ৩১]
“মুমিন পুরুষদের বল তারা যেনো তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তার খবর রাখেন।
মুমিন মহিলাদেরকে বল তারা যেন তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে।
তারা যেন তাদের সাজ দেখিয়ে না বেড়ায় এটুকু ছাড়া যা আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
তারা যেন তাদের বুকের ওপর ওড়নার আঁচল দিয়ে রাখে।
তারা যেন তাদের সাজ প্রকাশ না করে, তবে তাদের সামনে ছাড়া ঃ তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে, নিজের স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ঘনিষ্ঠ চেনা-জানা মহিলা, নিজেদের দাস, অধীনস্থ এমন পুরুষ যাদের অন্য রকম চাহিদা নেই এবং এমন বালক যারা মেয়েদের গোপন বিষয় জানে না।
তারা যেন তাদের গোপন সাজ সম্পর্কে লোকদেরকে জানাবার উদ্দেশ্যে যমীনে জোরে পা ফেলে না চলে।
হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَّدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আলে ইমরান : ১০৪]
“তোমাদের মধ্য হতে এমন একদল লোক থাকতে হবে যারা লোকদেরকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, মা‘রূফ কাজের নির্দেশ দেবে এবং মুনকার থেকে বিরত রাখবে। আর এরাই সফল।”
فَاتَّقُوْا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا وَأَنْفِقُوْا خَيْرًا لِّأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আত্ তাগাবুন : ১৬]
“আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করে চল। শুন, আনুগত্য কর এবং ইনফাক কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।”
لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِيْنَ الَّذِيْنَ أُخْرِجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُْونَ اللهَ وَرَسُولَه أُوْلئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ تَبَوَّؤُوْا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِى صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِّمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আল হাশর : ৮, ৯]
“(ঐ মাল) ঐ দরিদ্র মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের বাড়ি-ঘর ও সহায়-সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদকৃত। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ প্রত্যাশী। এরাই সত্যনিষ্ঠ।
(ঐ মাল তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে বসবাস করছিলো। তারা ঐসব লোকের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা হিজরাত করে তাদের কাছে এসেছে।
এমনকি মুহাজিরদেরকে যা কিছু দেওয়া হয় সেই বিষয়ে তারা নিজের
অন্তরে কোন চাহিদা পর্যন্ত অনুভব করে না।
নিজেদের যতো অভাবই থাকুক না কেন তারা নিজেদের ওপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَابْتَغُوْا إِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِى سَبِيْلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ [সূরা আল মা-য়িদা : ৩৫]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধানে লেগে থাক এবং তাঁর পথে জিহাদ কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِىْ التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيْلِ وَالْقُرْانِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِه مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِى بَايَعْتُمْ بِه وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আত্ তাওবা : ১১১]
“আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মারে ও মরে। তাদেরকে জান্নাত দেবার মজবুত ওয়াদা আত্ তাওরাত, আল ইনজীল ও আল কুরআনে করা হয়েছে। ওয়াদা পালনে আল্লাহর চেয়ে বেশি যোগ্য আর কে আছে? অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে যেই বেচা-কেনা করেছো সেই ব্যাপারে খুশি হয়ে যাও। এটা অতি বড় সফলতা।”
الَّذِيْنَ امَنُوْا وَهَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْفَائِزُوْنَ[সূরা আত্ তাওবা : ২০]
“আল্লাহর কাছে তো ঐসব লোকের মর্যাদাই বড় যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে। আর এরাই তো সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلى تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِّنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُولِه وَتُجَاهِدُوْنَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِىْ جَنَّاتِ عَدْنٍ ذلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আছ্ ছাফ : ১০-১২]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমি কি তোমাদেরকে এমন ব্যবসার কথা বলবো যা তোমাদেরকে কষ্টদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং মাল ও জান দিয়ে তাঁর পথে জিহাদ কর। যদি তোমরা জান, এটাই তো তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন, তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। তোমাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে উত্তম ঘর দেবেন। এটি অতি বড় সফলতা।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلحُوْنَ [সূরা আল আনফাল : ৪৫]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কোন বাহিনীর সাথে তোমাদের মুকাবিলা হলে তোমরা দৃঢ়পদ থাক এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اصْبِرُواْ وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
[সূরা আলে ইমরান : ২০০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, ছবর অবলম্বন কর, বাতিলপন্থীদের মুকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর, সদা-সর্বদা প্রস্তুত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করে চল, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
لـكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا مَعَهُ جَاهَدُوْا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُوْلـئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আত্ তাওবা : ৮৮]
“কিন্তু রাসূল এবং ঐসব লোক যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে। এদের জন্যই তো সব কল্যাণ। আর এরাই তো সফল।”
لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاخِرِ يُوَادُّوْنَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُولَه وَلَوْ كَانُوْا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيْرَتَهُمْ أُوْلئِكَ كَتَبَ فِيىْ قُلُوْبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ أُوْلئِكَ حِزْبُ اللهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আল মুজাদালা : ২২]
“তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদেরকে ভালোবাসে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করছে, ঐ লোকেরা চাই তাদের পিতা, পুত্র, ভাই কিংবা গোষ্ঠীর কেউ হোক না কেন। আল্লাহ এইসব লোকের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণা প্রবাহিত থাকবে। তারা সেখানে থাকবে চিরদিন। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর বাহিনী। জেনে রাখ, আল্লাহর বাহিনীর লোকেরাই সফল।”
এইসব আয়াতে সফল জীবনের যেইসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে সেইগুলোকে আমরা নিুরূপে সাজিয়ে নিতে পারি ঃ
১।আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা-ইখতিয়ার কিংবা অধিকারে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হওয়া।
২।আখিরাতের জওয়াবদিহিতা, শাস্তি ও পুরস্কারের কথা মনে জাগ্রত রেখে জীবন যাপন করা।
৩।কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা জানার পর বিনা দ্বিধায় মেনে চলা।
৪।একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করতে থাকা।
৫।ছালাত কায়েম করা ও খুশু সহকারে ছালাত আদায় করা।
৬।যাকাত আদায় করা।
৭।আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়গুলোর অনুশীলন করতে থাকা।
৮।আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত থাকা।
৯।ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ করতে থাকা।
১০।মা‘রূফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকারের উচ্ছেদে চেষ্টিত থাকা।
১১।সর্বাবস্থায় ছবর অবলম্বন করা।
১২।যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকা।
১৩।আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরের হক আদায় করা।
১৪।সুদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৫।মদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৬।জুয়া থেকে বেঁচে থাকা।
১৭।আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করা হয় এমন স্থান পরিহার করে চলা।
১৮।তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্য গণনা থেকে বেঁচে থাকা।
১৯।নাপাক জিনিস পরিহার করা।
২০।অবৈধ যৌনাচার থেকে বেঁচে থাকা।
২১।পর নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বেঁচে থাকা।
২২।আমানাতের হিফাযাত করা।
২৩।ওয়াদা-প্রতিশ্র“তি পালন করা।
২৪।বেহুদা কাজ থেকে বেঁচে থাকা।
২৫।কৃপণতা থেকে মুক্ত হওয়া।
২৬।আত্মীয়-স্বজন হলেও যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তাদেরকে ভালো না বাসা।
লক্ষ্য করার বিষয়, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়াকে কোথাও সফলতার মাপকাঠি বলে উল্লেখ করেন নি।
দুনিয়া প্রীতি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর অনুরাগ। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদের প্রতি মানুষ দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে। একটি সীমা পর্যন্ত এই অনুরাগ ও আকর্ষণ আপত্তিকর নয়। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলেই ঘটে বিপত্তি।
দুনিয়া-প্রীতি মানুষের জন্য দারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে দুনিয়ার জীবন তো খুবই সংক্ষিপ্ত। এক সময় সকল আপনজন এবং সব সম্পদ পেছনে ফেলে আখিরাতে পাড়ি দিতে হয়। দুনিয়া-প্রীতি মানুষকে আখিরাতমুখী হতে দেয় না। আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে।
সেই জন্যই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত অবস্থা বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে প্রতারণার শিকারে পরিণত না হয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِيْنَ وَالْقَنَاطِيْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَه حُسْنُ الْمَابِ[সূরা আলে ইমরান : ১৪]
“মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তুপ, সেরা ঘোড়া, গৃহপালিত পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আকর্ষণকে খুবই সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এইগুলো দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর কাছে তো রয়েছে উত্তম আবাস।”
الْمَالُ وَالْبَنُوْنَ زِيْنَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا [সূরা আল্ কাহফ : ৪৬]
“এই অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি তোমাদের দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সাজ-সজ্জা মাত্র। আসলে তো টিকে থাকার মতো নেক আমলই তোমার রবের নিকট পরিণামের দিক দিয়ে উত্তম। এবং এই বিষয়েই ভালো কিছু আশা করা যায়।”
إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللهُ عِنْدَه أَجْرٌ عَظِيْمٌ [সূরা আত্ তাগাবুন : ১৫]
“অবশ্যই তোমাদের অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে বিরাট প্রতিদান।”
اِعْلَمُوْا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِى الْأَمْوَالِ وَالْاَوْلاَدِ [সূরা আল হাদীদ : ২০]
“জেনে নাও, দুনিয়ার জীবন একটি খেলা, তামাশা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব-অহংকার এবং অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে একে অপরকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ [সূরা আল আনকাবুত: ৬৪]
“আর দুনিয়ার জীবন তো হাসি-তামাশা, খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আখিরাতের ঘরÑ সেটাই তো জীবনÑ যদি ওরা জানতো ঘর।”
“অর্থাৎ এর (দুনিয়ার জীবনের) বাস্তবতা শুধুমাত্র এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য নেচে-গেয়ে আমোদ করে এবং যার যার ঘরে চলে যায়। এখানে যে রাজা হয়ে গেছে সে আসলে রাজা হয়ে যায় নি বরং শুধুমাত্র রাজার অভিনয় করছে। এক সময় তার এই খেলা শেষ হয়ে যায়। তখন সে তেমনি দীনহীন অবস্থায় রাজ সিংহাসন থেকে বিদায় নেয় যেইভাবে এই দুনিয়ার বুকে এসেছিলো। অনুরূপভাবে জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয়। যে যেই অবস্থায়ই আছে সাময়িকভাবে একটি সীমিত সময়ের জন্যই আছে। মাত্র কয়েক দিনের জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এরই জন্য বিবেক ও ঈমান বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি প্রতিপত্তির জৌলুস করায়ত্ত করে নেয়, তাদের এই সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এইসব খেলনার সাহায্যে তারা যদি দশ, বিশ বা ষাট, সত্তর বছর মন ভুলানোর কাজ করে থাকে এবং তারপর শূন্য হাতে মৃত্যুর দরোজা অতিক্রম করে এমন জগতে পৌঁছে যায় যেখানকার স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনে তাদের এই খেলা এক প্রতিকারহীন রোগে পরিণত হয়, তাহলে এই ছেলে ভুলানোর লাভ কি?”[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী ১১শ খণ্ড, সূরা আল ‘আনকাবূতের তাফসীরের ১০২ নাম্বার টীকা।]
فَمَا أُوْتِيْتُمْ مِّنْ شَىْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَّأَبْقى لِلَّذِيْنَ امَنُوْا وَعَلى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ [সূরা আশ্ শূরা : ৩৬]
“তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা দুনিয়ার (ক্ষণস্থায়ী) জীবনের সামগ্রী। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা যেমনি উত্তম তেমনি স্থায়ী। তা সেই সব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করেছে।”
وَلَوْلاَ أَنْ يَّكُوْنَ النَّاسُ أُمَّةً وَّاحِدَةً لَّجَعَلْنَا لِمَنْ يَّكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِّنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُوْنَ وَلِبُيُْوتِهِمْ أَبْوَابًا وَسُرُرًا عَلَيْهَا يَتَّكِؤُوْنَ وَزُخْرُفًا وَإِنْ كُلُّ ذلِكَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِيْنَ [সূরা আয্ যুখরুফ : ৩৩-৩৫]
“সকল মানুষ একই পথ ধরার আশংকা না থাকলে আমি কাফিরদের ঘরের ছাদ, যেই সিঁড়ি দিয়ে তারা উপরে ওঠে সেই সিঁড়ি, তাদের ঘরের দরওয়াজাগুলো এবং যেই উচ্চাসনে তারা হেলান দিয়ে বসে রূপা ও সোনা বানিয়ে দিতাম। এইগুলো তো পার্থিব জীবনের (সামান্য) উপকরণ। তোমার রবের নিকট আখিরাত তো কেবল মুত্তাকীদের জন্য নির্ধারিত।”
“অর্থাৎ এই সোনা-রূপা যা কারো লাভ করা তোমাদের দৃষ্টিতে চরম নিয়ামাত প্রাপ্তি এবং সম্মান ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে এতই নগণ্য যে যদি সকল মানুষের কুফরের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে তিনি প্রত্যেক কাফিরের বাড়ি-ঘর সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করে দিতেন। এই নিকৃষ্ট বস্তুটি কখন থেকে মানুষের মর্যাদা ও আত্মার পবিত্রতার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই সম্পদ তো এমন সব মানুষের কাছেও আছে যাদের ঘৃণ্য কাজ-কর্মের পংকিলতায় গোটা সমাজ পুঁতিগন্ধময় হয়ে যায়। আর একেই তোমরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছো।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা আয্ যুখরুফের তাফসীরের ৩৩ নাম্বার টীকা।]
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا يَتَمَتَّعُوْنَ وَيَأْكُلُوْنَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ
[সূরা মুহাম্মাদ : ১২]
“আর কাফিররা দুনিয়ার ক’দিনের মজা লুটছে। জন্তু-জানোয়ারের মতো পানাহার করছে। ওদের চূড়ান্ত ঠিকানা জাহান্নাম।”
وَلاَ تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلى مَا مَتَّعْنَا بِه أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيْهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَّأَبْقَى [সূরা তা-হা : ১৩১]
“দুনিয়ার জীবনের এই জাঁকজমক যা আমি তাদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়েছি সেই দিকে তুমি চোখ তুলেও তাকাবে না। এইসব তো তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য দিয়েছি। আর তোমার রবের রিয্কই উত্তম ও স্থায়ী।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اِنَّ لِكُلِّ اُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ اُمَّتِى الْمَالُ.
[কা‘ব ইবনু ইয়াদ (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“অবশ্যই প্রত্যেক উম্মাতের জন্য রয়েছে এক একটি ফিতনা। আমার উম্মাতের ফিতনা হচ্ছেÑ অর্থ-সম্পদ।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلاَ أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِىْ تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفى إِلَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُوْلئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوْا وَهُمْ فِى الْغُرُفَاتِ امِنُوْنَ [সূরা সাবা : ৩৭]
“তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি এমন নয় যে তা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে, তবে যারা ঈমান আনে এবং আমালে ছালেহ করে তারা এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে অবস্থান করবে।”
وَما الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُوْرِ [সূরা আলে ইমরান : ১৮৫]
“আর দুনিয়ার জীবন তো ছলনার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذلِكَ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ [সূরা আল মুনাফিকুন : ৯]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না রাখে। যারা এমনটি করবে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
“বিশেষভাবে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির উল্লেখ করা হয়েছে এই জন্য যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এইসব স্বার্থের কারণে ঈমানের দাবি পূরণ না করে নিফাক অথবা ঈমানের দুর্বলতা অথবা পাপাচার ও না-ফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী, ১৭শ খণ্ড, সূরা আল মুনাফিকুনের তাফসীরের ১৮ নাম্বার টীকা।]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقى كَافِرًا مِنْهَا شِرْبَةَ مَاءٍ[সাহল ইবনু সা‘দ (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“আল্লাহর নিকট দুনিয়াটার মূল্য যদি একটি মশার ডানার মূল্যের সমান হতো, তাহলে তিনি কোন কাফিরকে এর থেকে এক চুমুক পানি পান করতে দিতেন না।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
يا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ [সূরা ফাতির : ৫]
“ওহে মানব জাতি, অবশ্যই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।”
فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ [সূরা লোকমান : ৩৩]
“অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। আর ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে না পারে।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ اَحَبَّ دُنْيَاه اَضَرَّبِاخِرَتِه وَمَنْ اَحَبَّ اخِرَتَه اَضَرَّبِدُنْيَاه فَاثِرُوْامَا يَابْقى عَلى مَا يَفْنى
[আবু মূসা আল আশ‘আরী (রা)। আহমাদ, ইবন হিব্বান, আল বাযযার, আল হাকিম, আল বাইহাকী।]
“যেই ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালোবাসে সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালোবাসে সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব যা ধ্বংসশীল তার ওপর যা স্থায়ী তাকে অগ্রাধিকার দাও।”
জাতিগতভাবে দুনিয়া-প্রীতির পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
يُوْشِكُ الاُمَمُ اَنْ تَدَاعى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الاكِلَةُ اِلى قَصْعَتِهَا- فَقَالَ قَائِلٌ وَ مِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ بَلْ اَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيْرٌ وَلكِنَّكُمْ غُثَاءً كَغُثَاءِ السَّيْلِ- وَلَيَنْزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُوْرِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ- وَلِيَقْذِفَنَّ فِى قُلُوْبِكُمْ الْوَهْنَ- قاَلَ قاَئِلٌ ياَّ رَسُوْلَ اللهِ وَماَ الْوَهْنُ؟ قاَلَ حُبُّ الدُّنْياَ وَكَرَ اهِيَةِ الْمَوْتِ. [সাওবান (রা), সুনানু আবী দাঊদ]
“অচিরেই তোমাদের ওপর অন্য জাতিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্য সামগ্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন জিজ্ঞেস করলো ঃ ‘তখন কি আমরা সংখ্যায় খুব কম থাকবো?’ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “না তোমরা বরং সংখ্যায় বেশি হবে, কিন্তু তোমরা বন্যা-স্রোতের ওপরে ভাসমান ফেনার মতো হবে। আল্লাহ শত্র“দের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন। তোমাদের অন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টি করে দেবেন।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো ঃ ‘সেই দুর্বলতা কি?’ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দুনিয়া-প্রীতি এবং মৃত্যুর প্রতি অনীহা।”
অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়বে এবং জিহাদের কথা শুনলে প্রাণ ভয়ে পিছটান দেবে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِى سَبِيْلِه فَتَرَبَّصُواْ حَتَّى يَأْتِىَ اللهُ بِأَمْرِه وَاللهُ لاَ يَهْدِى الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ [সূরা আত্ তাওবা : ২৪]
“তাদেরকে বল ঃ তোমাদের আব্বা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা যার মন্দার আশংকা তোমরা কর, তোমাদের পছন্দের ঘড়-বাড়ি যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ থেকে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসিকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন না।”
এই আয়াতের দাবি হচ্ছে,
দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে একজন মুমিনের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ প্রিয়তর হতে হবে।
অর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদকে অগ্রাধিকার দিতে পারার ওপরই নির্ভর করে তার আখিরাতের সফলতা।
অনাড়ম্বর জীবন যাপন
হারাম থেকে বেঁচে, হালালের গণ্ডিতে থেকে, কারো কাছে হাত না পেতে এবং ঋণগ্রস্ত না হয়ে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মতো অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করে। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলেও উত্তরোত্তর অর্থ-সম্পদের পেছনে দৌড়ানোকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে।
এক শ্রেণীর লোক অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়া, রকমারী বিলাস সামগ্রী সংগ্রহ করা এবং প্রতিপত্তিশালী হওয়ার জন্য অহর্নিশ মেতে থাকে। বিস্ময়ের ব্যাপার, তাদের এই চাওয়ার কোন শেষ নেই। ‘আরো চাই, আরো চাই’- এই যেন তাদের চিন্তা-চেতনার সারকথা। এই মনোভংগিকেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন “আত্ তাকাসুর” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন,
أَلْهكُمُ التَّكَاثُرُ. حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ [সূরা আত্ তাকাছুর : ১, ২]
“আধিক্যের মোহ তোমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যেই পর্যন্ত না তোমরা কবরে পৌঁছ।”
এই মনোভংগি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَوْ كَانَ لاِبْنِ ادَمَ وَادِياَنِ مِنْ ذَهَبٍ لاَحَبَّ اَنْ يَكُوْنَ لَه ثاَلِتٌ وَلاَ يَمْلَءَ فَاهُ اِلاَّ التُّرَابُ.
[আনাস ইবনু মালিক (রা), সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ।]
“আদম সন্তান যদি দুইটি স্বর্ণ ভরা উপত্যকা লাভ করে, তবুও সে তৃতীয় আরেকটি লাভ করতে চাইবে। মাটি ছাড়া আর কিছুই তার মুখ ভরতে পারে না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَا ذِئْباَنِ جاَئِعاَنِ اُرْسِلاَ فِىْ غَنَمٍ بِاَفْسَدَ لَهاَ مِنْ حَرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْماَلِ وَالشَّرْفِ لِدِيْنِهِ [কা‘ব ইবনু মালিক (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“অর্থ-সম্পদের লোভ এবং অভিজাত হওয়ার লালসা একজন ব্যক্তির দীনদারীর জন্য এত বেশি ক্ষতিকর যে বকরীর পালে পতিত দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘও বকরীর পালের এত বেশি ক্ষতি করতে পারে না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَيْسَ لاِبْنِ ادَمَ حَقٌّ فِىْ سِوى هذِهِ الْخِصاَلِ بَيْتٌ يَسْكُنُهُ وَثَوْبٌ يُّوارِىْ عَوْرَتَهُ وَجِلْفُ الْخُبْزِ وَالْمَاءِ.
[উসমান ইবনু আফফান (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“আদম সন্তানের এই কয়টা বস্তু ছাড়া আর কিছুর অধিকার নেই। বসবাসের জন্য একটি ঘর, লজ্জা নিবারণের জন্য কিছু কাপড় এবং কিছু রুটি ও পানি।” অর্থাৎ এইগুলো মানুষের প্রকৃত মৌলিক প্রয়োজন।
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مِنْ سَعاَدَةِ الْمَرْءِ الْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ وَالْجَارُ الصَّالِحُ وَالْمَرْكَبُ الْهَنِيْئُ.
[নাফে ইবনু আবদিল হারিস (রা), মুসনাদে আহমাদ]
“কোন ব্যক্তির কতক সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ঃ প্রশস্ত বসত ঘর, নেক প্রতিবেশী এবং আরামপ্রদ বাহন।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
قَدْ اَفْلَحَ مِنْ اَسْلَمَ وَكَانَ رِزْقُهُ كَفَافاً وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا اتَاهُ.
[আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস (রা), সহীহ মুসলিম]
“সেই ব্যক্তি সফল যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, প্রয়োজন মাফিক রিয্ক পেয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দিয়েছেন।”
আহওয়াছ (রা) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,
اَتَيْتَ رَسُوْلَ اللهِ (ص) وَ عَلَىَّ ثَوْبٌ دُوْنٌ- فَقَالَ لِىْ اَلَكَ مَالٌ؟ فَقُلْتُ نَعَمْ- قَالَ مِنْ اَىِّ الْمَالِ؟ قُلْتُ مِنْ كُلِّ الْمَالِ- قَدْ اَعَطَانِىْ اللهُ مِنَ الابِلِ وَالْبَقَرِ وَالْغَنَمِ وَالْخَيْلِ وَالرَّقِيْقِ- قَالَ فَاِذَا اتَاكَ مَالاً فَلْيُرَ اَثَرُ نِعْمَةِ اللهِ عَلَيْكَ.[আহওয়াছ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
“আমি একবার খুবই নিুমানের পোশাক পরে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, “হাঁ, আছে।” তিনি বললেন, “কি কি ধরনের ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, “সব রকমের ধন-সম্পদ। উট, গাভী, বকরী, ঘোড়া এবং দাস-দাসী।” তিনি বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তোমার অবয়বে তার নিয়ামাতের প্রকাশ পাওয়া উচিত।”
একজন ব্যক্তিকে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন অর্থ-সম্পদ দান করা সত্ত্বেও সে ফকিরের মতো জীবন-যাপন করবে এটাও অভিপ্রেত নয়।
কিন্তু নিজের অবয়বে আল্লাহর নিয়ামাতের প্রকাশ ঘটানোর অর্থ- বিলাসী জীবন-যাপন নয়। বিলাস-ব্যসন পরিহারকরণ এবং অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের তাকিদ দিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِيَّاكَ وَالتَّنَعُّمَ فَاِنَّ عِبَادَ اللهِ لَيْسُوْا بِالْمُتَنَعِّمِيْنِ.
[মুয়ায ইবন জাবাল (রা), মুসনাদে আহমাদ, সুনানু আল বাইহাকী]
“বিলাসিতা থেকে বেঁচে থেকো। অবশ্যই আল্লাহর বান্দারা বিলাসী হয় না।”
বাস্তব জীবনে দেখা যায়, বিলাসিতা থেকে জন্ম নেয় আরামপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা থেকে জন্ম নেয় অলসতা আর অলসতা থেকে জন্ম নেয় পরিশ্রমবিমুখতা।
বিলাসিতামুক্ত জীবন-যাপনের তাকিদ দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلاَ تَسْمَعُوْنَ اَلاَ تَسْمَعُوْنَ اِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنْ الايِمَانِ اِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنْ الايْمَانِ.
[আবু উমামা ইয়াস (রা), সুনানু আবী দাউদ]
“তোমরা কি শুনছো না। তোমরা কি শুনছো না। নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক, নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
كُنْ فِى الدَّنْيَا كَاَنَّكَ غَرِيْبٌ اَوْ عَابِرِ سَبِيْلٍ.
[আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), সহীহ আল বুখারী]
“তুমি দুনিয়াতে একজন মুসাফির কিংবা একজন পথচারীর মতো হয়ে থাক।”
আমরা জানি একজন মুসাফির কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সফরে যান। তিনি অল্প ক’দিনের জন্য সফরে যান। তিনি সহজে বহনযোগ্য অত্যাবশ্যক বোঝা সাথে নেন।
এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য। এখানে তার অবস্থানও হাতে গোনা ক’টি দিনের জন্য।
ডাক পড়লেই তাকে তৎক্ষণাত এখান থেকে চলে যেতে হয়।
অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান মুসাফিরের মতোই।
অর্থাৎ তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের বোঝা বহন করার প্রয়োজন নেই।
সফরটা মোটামুটি স্বচ্ছন্দ হওয়ার মতো পাথেয় থাকাই যথেষ্ট।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
فَوَ اللهِ مَا الْفَقْرَ اَخْشى عَلَيْكُمْ وَلكِنِّى اَخْشى اَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوْهَا كَمَا تَنَافَسُوْهَا فَتُلْهِكَكُمْ كَمَا اَهْلَكَتْهُمْ.
[আমর ইবনু আওফ আলআনছারী (রা), সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম]
“আল্লাহর কসম, তোমাদের জন্য আমি দারিদ্রের ভয় করছি না, বরং ভয় করছি যে তোমাদের সামনে পার্থিব প্রাচুর্য প্রসারিত করা হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিলো। অতপর তোমরা পার্থিব প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতায় লেগে যাবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা লেগেছিলো এবং এটি তোমাদেরকে ধ্বংস করবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছিলা।”
উল্লেখ্য যে, কম পাওয়ার বেদনা মানুষকে দারুণভাবে পীড়ন করে। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই বেদনা দূর করে দেয়। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড ভোগের আকাংখা বিদ্যমান। এই আকাংখার যেন নিবৃত্তি নেই, শেষ নেই। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই আকাংখা নিয়ন্ত্রণ করে। ভোগবাদ এক মহা আপদ। ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষ উ™£ান্তের মতো ছুটতে থাকে। অল্পে তুষ্টি এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়।
অর্থাৎ অল্পে তুষ্টি এক অসাধারণ গুণ। এই গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব অনাড়ম্বর জীবন-যাপন।
অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের
কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
১। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) :
মানব-শ্রেষ্ঠ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মাক্কায় অবস্থানকালে নবুওয়াত লাভের পূর্বে ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়ে তিনি সচ্ছলতার অধিকারী হন। তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ ব্যয়িত হতো অভাবী ও দুঃখী মানুষের কল্যাণে। নবুওয়াত লাভের পর তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় ব্যবসা চালানো ছিলো সুকঠিন। তদুপরি আদ্দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ এবং নও মুসলিমদের তা‘লীম ও তারবিয়াতে তাঁর বেশিরভাগ সময় ব্যয় হতে থাকে।
ঈসায়ী ৬২২ সনে তিনি ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। ইতোমধ্যে সেখানে ইসলামের পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিলো। তাঁর আগমনের পর ইয়াসরিব একটি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর নাম হয় আলমাদীনা। এই নব গঠিত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি বৈধভাবেই বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
তিনি সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
তিনি বসবাস করতেন ছোট্ট ঘরে। তাঁর ঘরটি ছিলো আসবাবপত্রের বাহুল্য মুক্ত। তিনি ব্যবহার করতেন চামড়ার তৈরি একটি বিছানা। এর ভেতরে ছিলো খেজুর গাছের ছোবড়া।
তিনি ভুরি-ভোজ পছন্দ করতেন না।
ঠেসে ঠেসে পেট ভর্তি করে খাবার খেতেন না। তবে দুধ ও মধু খুব পছন্দ করতেন।
তিনি চোখে সুরমা লাগাতেন।
আতর ব্যবহার করতেন।
তিনি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন না।
কোন কোন সময় ভিন্ন রঙের পোশাক পরলেও সাদা রঙের পোশাকই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।
তাঁর বহু সংখ্যক কাপড়-চোপড় ছিলো না। ফলে এইগুলো ভাঁজ করে ¯তূপ করে রাখার প্রয়োজন পড়তো না।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
২। আবু বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা) :
আবু বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা) ছিলেন মাক্কার সেরা ব্যবসায়ীদের একজন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর সঞ্চয় ছিলো চল্লিশ হাজার দিরহাম। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেকার একজন মানুষের হাতে চল্লিশ হাজার দিরহাম থাকাটা কোন ছোট্ট ব্যাপার ছিলো না।
ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরোধীদের সৃষ্ট প্রতিকূলতার কারণে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে ওঠে।
অথচ পরিবার থেকে বিতাড়িত নওমুসলিমদের পুনর্বাসন এবং নির্যাতিত দাস-দাসিদের মুক্তির জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। হিজরাতের সময় দেখা গেলো তাঁর হাতে বাকি আছে আর মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম। আর মাদীনায় এসে তিনি আবার ব্যবসাতে মনোযোগ দেন। তবে ব্যবসালব্ধ অর্থের বেশিরভাগ তিনি আদ্দাওয়াতু ইলাল্লাহ, আল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ এবং বহুবিধ জনহিতকর খাতে ব্যয় করতেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওফাতের পর তিনি আল মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হন।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাবার জন্য ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান।
প্রবীণ ছাহাবীগণ তাঁকে এর থেকে বিরত রাখেন। তাঁরা তাঁর জন্য বাইতুল মাল থেকে একটি ভাতা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন।
তিনি বছরে মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম নিতে রাজি হন।
তিনি খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
বাইতুল মাল থেকে তিনি বছরে দুই সেট পোশাক পেতেন। এতেই তিনি পরিতৃপ্ত ছিলেন।
মৃত্যুকালে তিনি একজন দাসি এবং দুইটি উটনি ছাড়া আর কোন সম্পদ রেখে যান নি।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ওয়াছিয়াত করে যান, মৃত্যুর পর যেন তাঁর পরনের কাপড়টি ধুয়ে তার সাথে আরো দুই টুকরো কাপড় মিলিয়ে তাঁর কাফন দেয়া হয়।
৩। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ছিলেন মাক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একজন। আল মাদীনায় হিজরাত করে আসার পর তিনি নতুন ভাবে ব্যবসা শুরু করেন। মুনাফার টাকার বিরাট অংশ আদ্দাওয়াত, আল জিহাদ ও খিদমাতে খালকে ব্যয় করতেন।
আবু বাকর আছ্ছিদ্দিকের (রা) ওফাতের পর তিনি আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। যুগপৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও ব্যবসা চালানো খুবই কঠিন ছিলো। তথাপিও তিনি কয়েক বছর পর্যন্ত বাইতুল মাল থেকে ভাতা নিতে রাজি হননি। রাষ্ট্রীয় কাজের চাপে যখন ব্যবসাতে সময় দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন তিনি ভাতা গ্রহণে রাজি হন। তাও বছরে মাত্র আটশত দিরহাম। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল বেশ সমৃদ্ধ হয়। তখন সকলকেই ভালো পরিমাণ ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়। এই সময় তিনি বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নিতে সম্মত হন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবু বাকর আছ্ছিদ্দিকের (রা) মতোই ছিলো তাঁর জীবনধারা।
তিনি সাধারণ খাবার খেতেন।
কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
৪। উসমান ইবনু আফফান (রা) :
উসমান ইবনু আফফান (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন। ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরুদ্ধবাদীদের সন্ত্রাসের কারণে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
আল মাদীনায় হিজরাতের পর তিনি আবার ব্যবসা সংগঠিত করেন। আল্লাহ তাঁর ব্যবসাতে বারাকাত দিতেন। তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন।
তুলনামূলকভাবে তিনি ভালো পোশাক পরতেন এবং ভালো খাবার খেতেন। কিন্তু তিনিও বিলাসী জীবন যাপন করতেন না।
তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ আদ্দাওয়াত, আল জিহাদ ও জনহিতকর খাতে ব্যয়িত হতো।
মসজিদে নববী সম্প্রসারণের জন্য পার্শ্ববর্তী জমি কিনে তিনি তা ওয়াক্ফ করে দেন।
তখন আল মাদীনায় পান যোগ্য পানির বড়ো অভাব ছিলো। এক ইয়াহুদীর মালিকানাধীন রুমা কূপের পানি ছিলো পানযোগ্য। সেই ইয়াহুদী বিনা পয়সায় এক গ্লাস পানি কাউকে দিতো না।
উসমান (রা) আঠারো হাজার দিরহামের বিনিময়ে সেই কূপ কিনে নেন এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন।
তাবুক যুদ্ধের ত্রিশ হাজার যোদ্ধার মধ্যে দশ হাজার যোদ্ধার যাবতীয় ব্যয় ভার তিনি বহন করেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাহাদাতের পর তিনি আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হন। বাইতুল মাল থেকে নির্ধারিত ভাতা তিনি গ্রহণ করতেন। কিন্তু নিজে ভোগ না করে অভাবী লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন।
৫। আলী ইবনু আবী তালিব (রা) :
আলী ইবনু আবী তালিব (রা) ব্যবসায়ী পিতার সন্তান ছিলেন। দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্যে থাকা অব্যাহত রাখেন। ব্যবসার দিকে তাঁর মন ছিলনা। অংশ অংশ করে আল কুরআন নাযিল হচ্ছিলো। আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে শুনে শুনে তিনি তা মুখস্থ করে নিতে থাকেন। নবী গৃহেই তিনি অবস্থান করতেন।
নবীর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই তিনি পানাহার করতেন।
আল মাদীনায় হিজরাত করে আসার পরও আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই তিনি বসবাস করতে থাকেন।
বদর যুদ্ধের পর তিনি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা ফতিমাকে (রা) বিয়ে করেন। এবার তাঁকে আলাদা ঘর নিতে হয়। আয়-রোজগারের কথা ভাবতে হয়। টুকটাক কাজ করে তিনি যা কিছু পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন।
কখনো কখনো তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ পেতেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে বাইতুল মাল সমৃদ্ধ হলে তাঁর জন্য বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারিত হয়।
তিনি ছিলেন খুবই দানশীল।
কোন সাহায্যপ্রার্থীকে তিনি খালি হাতে ফেরাতেন না। ফলে কখনো কখনো সপরিবারে অভুক্ত থাকতেন।
উসমান ইবনু আফফানের (রা) শাহাদাতের পর তিনি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরও তাঁর জীবনধারায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
তিনি কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
কখনো কখনো তাঁর গায়ে তালি দেয়া পোশাক শোভা পেতো।
শাহাদাতকালে তিনি রেখে যান নগদ মাত্র সাতশত দিরহাম।
৬। আয্যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) :
আয্যুবাইর ইবনুল আওয়ামও (রা) মাক্কার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আলমাদীনায় আসার পর নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন।
ব্যবসা থেকে তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন। মুনাফার একটি অংশ তিনি পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতেন। বাকি অংশ লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
তাঁর মালিকানাধীন দাসের সংখ্যা ছিলো এক হাজার।
এরা প্রতিদিন অর্থ উপার্জন করতো এবং তাদের মালিকের হাতে তুলে দিতো। দাসদের উপার্জিত সমুদয় অর্থ তিনি কম বিত্তবান লোকদের মধ্যে বিলি করে দিতেন।
তিনি অনাড়ম্বর পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
৭। তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) :
তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন। হিজরাত করে আলমাদীনায় এসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাতে সফলতাও অর্জন করেন।
ব্যবসালব্ধ অর্থের সামান্য অংশ পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করতেন। বাকি অংশ দান করে দিতেন।
একদিন সন্ধ্যাবেলা হাজরামাউত থেকে ব্যবসার মুনাফার সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর হাতে আসে। রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি ছটফট করতে থাকেন। কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না।
তাঁর স্ত্রী কারণ জানতে চান।
জওয়াবে তিনি বলেন, “সেই সন্ধ্যা থেকে ভাবছি, এতগুলো দিরহাম ঘরে রেখে ঘুমুলে একজন মানুষের তার রবের প্রতি কি ধারণা পোষণ করা হয়।”
স্ত্রী বলেন, “এতো চিন্তিত হওয়ার কি আছে? এতো রাতে আপনি গরীব-মিসকীন পাবেন কোথায়? সকাল হলেই বণ্টন করে দেবেন।”
স্ত্রীর কথায় তিনি শান্ত হন।
স্বচ্ছন্দে রাত কাটান।
ভোর না হতেই অনেকগুলো থলে এনে দিরহামগুলো ভাগ করে গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
তালহা (রা) প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন।
কিন্তু জীবনে বিলাসিতার ছোঁয়া লাগতে দেননি।
৮। সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) হিম্স নামক স্থানে গভর্নর নিযুক্ত হন। গভর্নর হয়েও তিনি একটি ছোট্ট ঘরে বসবাস করতেন।
উল্লেখযোগ্য কোন আসবাব ছিলোনা তাঁর ঘরে।
তিনি সাধারণ পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
একবার হিম্স থেকে একদল লোক আসে আলমাদীনায়। তাঁরা রাষ্ট্রপ্রধান উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁদেরকে হিম্সের গরীব মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করে দিতে বলেন। তাঁরা পরস্পর আলাপ করে একটি তালিকা তৈরি করে উমারের (রা) হাতে দেন।
তালিকার প্রথম নামটি ছিলো, ‘সায়ীদ ইবনু আমের।’
উমার (রা) জানতে চান, “এ কোন সায়ীদ?”
হিম্সবাসীগণ জানান যে, এই সায়ীদ হচ্ছেন তাঁদের গভর্নর।
তাঁর জীবনযাত্রার বিশদ বিবরণ শুনে তিনি তাঁর জন্য এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) বরাদ্দ করেন। অন্যদের জন্যও স্বতন্ত্র বরাদ্দ দেন। হিম্সবাসীগণ ফিরে গিয়ে সকলকে তাদের থলে বুঝিয়ে দিয়ে গভর্নরের কাছে তাঁর জন্য প্রেরিত থলেটি নিয়ে যান। থলে খুলে দীনারগুলো দেখেই তিনি বলে ওঠেন, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
তাঁর মুখে এই কথা শুনে স্ত্রী দরওয়াজার কাছে এসে জানতে চান, “আমীরুল মুমিনীন কি মারা গেছেন?” সায়ীদ বললেন, “না, আমার আখিরাত বরবাদ করার জন্য দুনিয়া আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘরে বিপদ এসে পড়েছে।” স্ত্রী বললেন, “বিপদটা দূর করে দিন।” সায়ীদ বললেন, “এই ব্যাপারে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?” স্ত্রী বললেন, “অবশ্যই।”
অতপর সায়ীদ দীনারগুলো ভাগ করে কয়েকটি থলেতে ভরে হিম্সের দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইসলামের সোনালী যুগে অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বহু সংখ্যক মানুষ। তাঁরা জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। বিলাসিতাকে তাঁরা তাঁদের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না।
আখিরাতের জীবনের সফলতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বলেই তাঁরা দুনিয়ার প্রতি এমন নির্মোহ হতে পেরেছিলেন।
আখিরাতের সফলতাই প্রকৃত সফলতা
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَن طَبَقٍ [সূরা আল ইনশিকাক : ১৯]
“তোমরা অবধারিতভাবে একটি পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো।”
একজন মানুষ জীবনের সূচনার পর থেকে শুরু করে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করে। অবশেষে তাকে দুনিয়ার জীবন শেষ করে কবরে পৌঁছতে হয়। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবরের বাসিন্দা হতে থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন পৃথিবী ও আসমান ভেংগে দেওয়ার ক্ষণ উপস্থিত হবে। ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়ে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। মহাকাশের সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়বে। সবকিছু ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে।
এরপর আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশে নতুন আকারে, নতুন রূপে, নতুন বিন্যাসে পৃথিবী ও আসমান আবার অস্তিত্ব লাভ করবে।
يَوْمَ تُبَدَّلُ الأَرْضُ غَيْرَ الأَرْضِ وَالسَّمواتُ [সূরা ইবরাহীম : ৪৮]
“সেই দিন পৃথিবী ও আসমানকে পরিবর্তিত করে নতুন আকার দেওয়া হবে।”
নতুনভাবে গড়া পৃথিবী হবে আজকের পৃথিবী থেকে অনেক বড়। নতুন পৃথিবীতে কোন সাগর-মহাসাগর থাকবে না। পাহাড়-পর্বত থাকবে না। গাছ-গাছালি থাকবে না। কোন ঘরদোর থাকবে না। গোটা পৃথিবী হবে একটি ধূসর সমতল প্রান্তর।
فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا .لَا تَرى فِيْهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا [সূরা তা-হা : ১০৬, ১০৭]
“অতপর এই পৃথিবীকে এক সমতল ধূসর প্রান্তরে পরিণত করা হবে। তুমি এতে উঁচু নিচু কিছু ও সংকোচন দেখতে পাবে না।”
“আলকাউসার” নামে একটি জলাধার হবে একমাত্র ব্যতিক্রম। নতুন পৃথিবী পৃষ্ঠে “আলকাউসার” ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না।
এই বিশাল ধূসর প্রান্তরে জীবিত করে ওঠানো হবে সকল মানুষকে।
فَإِذَا هُم قِيَامٌ يَنظُرُونَ .وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ
[সূরা আয্ যুমার : ৬৮, ৬৯]
“অতপর তারা উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার রবের নূরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। আমলনামা (প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে মুতায়েন দুইজন ফেরেশতা কর্তৃক তৈরি ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের বিবরণ) সামনে আনা হবে।”
চারদিকে আল্লাহর নূরের উদ্ভাসন দেখে প্রত্যেকেই বুঝবে, দুনিয়ার জীবনে আখিরাতের যেই আদালতে উপস্থিত হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে জ্ঞাত করা হয়েছিলো, তারা সেই আদালতে উপস্থিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে ঘোষণা হবে,
اقْرَأْ كتَابَكَ كَفى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا [সূরা বানী ইসরাঈল : ১৪]
“তোমার আমলনামা পড়। তুমিই আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা পড়বে। আর দেখবে তার কৃত কণা পরিমাণ নেক আমলের বিবরণ সেখানে আছে। আবার কণা পরিমাণ বদ আমলের বিবরণও আছে। “কিরামান কাতিবীন” (সম্মানিত লেখকবৃন্দ) কোন কিছু বাড়িয়েও লেখেন নি, কোন কিছু কমিয়েও লেখেন নি। প্রতিটি কাজের বিবরণ নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
অতপর শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদ। আল্লাহর প্রতিনিধি (খালীফা) ও আল্লাহর বান্দা (আবদ) হিসেবে দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর যেইসব কর্তব্য অর্পিত ছিলো, সেইগুলো সম্পন্ন করা সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
কোন কোন অপরাধী ব্যক্তি ধৃষ্টতা দেখাবে। তারা তাদের অতসব পাপের ফিরিস্তির বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতে চাইবে। তখন আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দ্বিতীয় প্রকারের সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করবেন।
আল্লাহর নির্দেশ লাভ করে তাদের প্রত্যংগগুলো তাদের কৃত কাজের বিবরণ পেশ করা শুরু করবে।
وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ. [সূরা ইয়া-সীন :৬৫]
“এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে। তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ.
[সূরা আন্ নূর : ২৪]
“সেই দিন তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُوْدُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ .
[সূরা হামীমুস্ সাজদা : ২০]
“তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের ত্বক (চামড়া) সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلاً
[সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬]
“নিশ্চয়ই তাদের কান, চোখ ও অন্তরকে জওয়াবদিহি করতে হবে।”
وَإِن تُبْدُواْ مَا فِيْ أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللهُ.
[সূরা আল বাকারা : ২৮৪]
“আর তোমাদের মনের কথা তোমরা প্রকাশ কর অথবা গোপন কর, আল্লাহ অবশ্যই সেই সম্পর্কে হিসাব নেবেন।”
এই জিজ্ঞাসাবাদ হবে সূক্ষ্ম, দীর্ঘ ও ব্যাপক।
এক পর্যায়ে ব্যক্তির “আমালে ছালেহ” সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। কোন্ আমল কোন্ অভিপ্রায়ে বা নিয়াতে করা হয়েছিলো তা বিশ্লেষণ করা হবে।
উল্লেখ্য যে “ইখলাছুন্নিয়াত” বা নিয়াতের বিশুদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। “ইখলাছুন্নিয়াত” সহকারে করা না হলে কোন আমালে ছালেহকে আল্লাহ স্বীকৃতি দেন না।
একদিন এক ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেসা করলো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা খ্যাতি অর্জনের জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকি। এতে কি আমরা পুরস্কৃত হবো?” আল্লাহর রাসূল বললেন, “না।” লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের নিয়াত যদি আল্লাহর পুরস্কার এবং দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন- দুইটিই হয়?” আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “কোন আমল খালিছভাবে তাঁর জন্য করা না হলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।”
[ইয়াযিদ আর রাকাশী (রা), ইবনু মারদুইয়া]
ইখলাছুন্নিয়াতের অভাবে বড়ো বড়ো ত্যাগ-কুরবাণী আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কবুল করেন না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“শেষ বিচারের দিন প্রথম পর্বে এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যে শহীদ হয়েছে। তাকে আল্লাহ প্রদত্ত সকল নিয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে এইসব নিয়ামাত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, “এই সব নিয়ামাত পাওয়ার পর তুমি আমার জন্য কী করেছো?” সে বলবে, “আমি আপনার পথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি।” আল্লাহ বলবেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বীর রূপে আখ্যায়িত হওয়ার জন্য লড়াই করেছো। সেই খ্যাতি তুমি পেয়েছো।” অতপর তার সম্পর্কে ফায়সালা দেওয়া হবে, তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।…..
অর্থাৎ আমালে ছালেহ গৃহীত হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে ইখলাছুন্নিয়াত।
আদ্দাওয়াত, আলজিহাদ, আছ্ছালাত, আছ্ছাওম, আয্যাকাত, আলহাজ, ইনফাক, খিদমাতে খালক তথা সবকিছু একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের সন্তোষ অর্জনের জন্যই নিবেদিত হতে হবে।
আল্লাহর আদালতে বিশ্লেষণে যদি প্রমাণিত হয় যে মুমিন সকল আমালে ছালেহ একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্যই সম্পন্ন করেছে, তাহলে তার নাজাতের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে।
আল্লাহর আদালতে বিচার পর্ব শেষ হওয়ার পর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জাহান্নাম, আর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জান্নাত।
জাহান্নামঃ
জাহান্নাম কঠিন শাস্তির স্থান।
ভয়ংকর আকৃতির ফেরেশতারা সেখানে নিযুক্ত রয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা পাপীদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দেহে লোহার শিকল পেঁচিয়ে টেনে- হেঁচড়ে নিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
জাহান্নামের আগুনের তেজ দুনিয়ার আগুনের তেজের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি।
জাহান্নামে ঘন শ্বাসরুদ্ধকর ঝাঁঝালো ধোঁয়া আবর্তিত হচ্ছে।
জাহান্নামের নানাস্থানে বিশাল আকৃতির ভয়ংকর বিষধর সাপ রয়েছে।
জাহান্নামীদের দেহ হবে বিশাল আকৃতির। ফেরেশতারা ভারি গুর্জ দিয়ে আঘাত হেনে জাহান্নামীদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে। জাহান্নামীরা ভীষণ চিৎকার করতে থাকবে।
আগুনের উত্তাপে ও পিপাসায় তারা হাঁপাতে থাকবে।
তাদেরকে ভীষণ গরম পানি ও রক্ত-পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে।
কাঁটাযুক্ত, তিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত যাক্কুম গাছ গিলতে বাধ্য করা হবে।
আরো বহুবিধ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে জাহান্নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“জাহান্নামের সবচে’ কম শাস্তি হবে তার যাকে আগুনের ফিতাযুক্ত একজোড়া জুতা পরানো হবে। এতেই তার মাথার মগজ জ্বলন্ত চুলার ওপর হাঁড়ির পানির মতো টগবগ করে ফুটতে থাকবে।” [সহীহ মুসলিম]
জান্নাতঃ
জান্নাত অনাবিল সুখ-শান্তির স্থান।
ফেরেশতারা জান্নাতীদেরকে খোশ আমদেদ জানিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।
জান্নাতের বাগানগুলো নয়নাভিরাম।
বাগানগুলো পাখ-পাখালিতে পূর্ণ।
চারদিকে ফুলের সমারোহ।
জান্নাতে প্রবাহিত হচ্ছে সুপেয় পনির ঝর্ণা, সুস্বাদু দুধের ঝর্ণা, স্বচ্ছ মধুর ঝর্ণা এবং উন্নতমানের পানীয়র ঝর্ণা।
জান্নাতে রয়েছে সুস্বাদু মাছ, গোশত, রকমারি খাদ্য এবং ফলের প্রাচুর্য।
জান্নাতে রয়েছে অনুপম উপাদানে তৈরি সারি সারি প্রাসাদ।
জান্নাতীদের জন্য আরামদায়ক পোশাক, শয্যা ও সুউচ্চ আসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
জান্নাত আলো ঝলমল।
জান্নাতে রয়েছে অগণিত সৌন্দর্য-শোভার উপকরণ।
জান্নাতের প্রতিটি বস্তুতে রয়েছে তুলনাহীন সুঘ্রাণ।
জান্নাত উত্তাপ ও শীতের প্রকোপমুক্ত।
জান্নাতীদের দৈর্ঘ্য হবে ষাট হাত।
সকল জান্নাতী হবেন যুবক ও যুবতী।
তারা লাভ করবেন চিরস্থায়ী যৌবন।
জান্নাতে কারো অসুখ হবেনা।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে অসাধারণ দৈহিক সৌন্দর্য দান করবেন।
তাদের দেহে থাকবে অনন্য সাধারণ সুঘ্রাণ।
জান্নাত মানুষের অনন্ত জীবন লাভ এবং বিশাল সম্পদ-সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার আকাংখা পূরণের স্থান।
প্রত্যেক জান্নতীকে জান্নাতের সুবিশাল অংশের মালিক বানিয়ে দেওয়া হবে।
আল্লাহ সবচে’ কম মর্যাদাবান জান্নাতীকেও বর্তমান পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ বেশি স্থান দেবেন।
وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيْمًا وَمُلْكًا كَبِيْرًا [সূরা আদ্ দাহর : ২০]
“এবং তুমি যেই দিকেই তাকাবে নিয়ামাত আর নিয়ামাতই দেখতে পাবে। আর দেখতে পাবে এক বিশাল সাম্রাজ্য।”
আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতা সীমাহীন।
তিনি নতুন নতুন নিয়ামাত সৃষ্টি করে জান্নাতীদেরকে উপহার দিতে থাকবেন।
لَهُمْ مَّا يَشَاؤُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ [সূরা কা-ফ : ৩৫]
“জান্নাতে তারা যা চাইবে, তা-ই পাবে। আর আমার পক্ষ থেকে আরো অনেক কিছু রয়েছে তাদের জন্য।
فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ [সূরা আস্ সাজদা : ১৭]
“তাদের চোখ জুড়াবার জন্য আমি যেইসব জিনিস গোপন করে রেখেছি তা তাদের কারোরই জানা নেই।”
اَعْدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّا لِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأتُ وَلاَ اُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلى قَلْبِ بَشَرٍ.[সহীহ আল বুখারী]
“(আল্লাহ বলেন,) আমি আমার ছালেহ বান্দাদের জন্য এমন এমন নিয়ামাত মওজুত করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, যার কথা কোন কান কখনো শুনেনি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয়নি।”
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে তাঁর দর্শন দান করে ধন্য করবেন।
যাঁর প্রতিনিধি (খালীফা) এবং বান্দা (আবদ) রূপে পৃথিবীতে কর্তব্য পালন করে তারা জান্নাতে স্থান পেলো, সেই আল্লাহকে দেখে তারা পরিতৃপ্ত হবে।
জান্নাতীদের কাছে সবচে’ বেশি আনন্দের বিষয় হবে আল্লাহর দর্শন।
জাহান্নামীরা জাহান্নামে এবং জান্নাতীরা জান্নাতে অবস্থান গ্রহণের পর মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করবেন, ‘ওহে জান্নামীরা, আর মৃত্যু নেই। ওহে জান্নাতীরা, আর মৃত্যু নেই। সামনে তোমাদের অনন্ত জীবন।”
আখিরাতের মৃত্যুহীন জীবন সম্পর্কে আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لاَ يَذُوْقُوْنَ فِيْهَا الْمَوْتَ إِلاَّ الْمَوْتَةَ الْأُولى [সূরা আদ্ দুখান : ৫৬]
“প্রথম মৃত্যুর পর ওখানে তারা আর মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে না।”
আখিরাতের অনন্ত জীবনের ব্যর্থতাই প্রকৃত ব্যর্থতা। আবার, সেই অনন্ত জীবনের সফলতাই প্রকৃত সফলতা।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لاَ يَسْتَوِيْ أَصْحَابُ النَّارِ وَأَصْحَابُ الْجَنَّةِ. أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَائِزُوْنَ
[সূরা আল হাশর : ২০]
“জাহান্নামের অধিবাসীরা এবং জান্নাতের অধিবাসীরা কখনো সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফল।”
আখিরাতের অনন্ত জীবনের সফলতাকে সামনে রেখে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ভূমিকা পালনের তাকিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَسَارِعُواْ إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّموَاتُ وَالأَرْضُ
[সূরা আলে ইমরান : ১৩৩]
“এবং তোমরা দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বি¯তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বি¯তৃতির সমান।”
سَابِقُوْا إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
[সূরা আল হাদীদ : ২১]
“তোমরা প্রতিযোগিতা করে দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বি¯তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বি¯তৃতির সমান।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلْكَيَّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَه وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ اَتْبَعَ نَفْسَه هَوَاهُ وَتَمَنَّى عَلَى اللهِ.[শাদ্দাদ ইবনু আউস (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের দিকে লক্ষ্য রেখে আমল করেছে। সেই ব্যক্তি নির্বোধ যে নিজকে নফসের হাতে সঁপে দিয়েছে, আবার আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশাও করছে।”